এনজিওকর্মী অরন্য চিরানের স্বাধীনতা পদক নিয়ে প্রশ্ন

অরন্যের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার দাবিতে মানববন্ধন। ছবি-সমকাল
নিজস্ব প্রতিবেদক, ময়মনসিংহ
প্রকাশ: ২০ মার্চ ২০২৪ | ১৫:৫৮
সমাজসেবায় অবদানের জন্য এ বছর রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার স্বাধীনতা পদকের জন্য মনোনীত হয়েছেন ময়মনসিংহের এনজিওকর্মী অরন্য চিরান। তার নাম পদকের জন্য ঘোষণার পর থেকে তুমুল সমালোচনা শুরু হয়েছে। কী কাজের জন্য তিনি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পুরস্কারে মনোনীত হলেন তা খুঁজে পাচ্ছেন না স্থানীয় নাগরিক সমাজ ও আদিবাসীরাও। পুরস্কারের তালিকায় অরন্যের নাম দেখে আশ্চর্য হয়েছেন সবাই। তার নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার দাবিতে বুধবার মানববন্ধন কর্মসূচি হয়েছে।
২০২৪ সালে দশ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব পদকের জন্য রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার স্বাধীনতা পদকের জন্য মনোনীত হয়েছেন। গত ১৫ মার্চ প্রকাশিত ওই তালিকায় ময়মনসিংহ থেকে চিকিৎসাবিদ্যায় ডা. হরিশংকর দাশ, ক্রীড়ায় ফিরোজা খাতুন ও সমাজসেবায় অরন্য চিরান মনোনীত হন। কিন্তু তিনজনের মধ্যে সমাজসেবায় অবদানের জন্য মনোনীত হওয়া অরন্য চিরানকে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে বিতর্ক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে পোস্ট করে তার নাম পদক থেকে বাতিলের দাবি জানিয়েছেন।
জানা যায়, অরন্য চিরানের বাড়ি ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার দক্ষিণ মাইজপাড়া ইউনিয়নের দিঘলবাগ গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের প্রয়াত ক্ষিতীশ মানখিনের ছয় ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে সবার বড়। ১৯৮০ সালের ২৯ নভেম্বর জন্ম নেওয়া অরন্য চিরান ‘সারা’ নামে একটি এনজিওতে ময়মনসিংহ শহরে প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর হিসেবে কাজ করেন ২০১১ সাল থেকে। এর আগে টাঙ্গাইলের মধুপুরে ও ধোবাউড়ায় দুটি স্কুলে ১৯৯৮ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন।
সমাজসেবার জন্য কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা কিংবা মানুষের কল্যাণকর কিছু করেছেন উল্লেখ করার মতো এমন কোনো বিষয় খুঁজে পাচ্ছে না স্থানীয়রা। তার নাম স্বাধীনতা পদকের জন্য ঘোষিত হওয়ার পর থেকে আদিবাসীদের পাশাপাশি স্থানীয় সামাজিক সংগঠন গুলোও অরন্য চিরানের অবদান খুঁজেছেন, কিন্তু পাননি কিছু। ময়মনসিংহ নাগরিক আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল আমিন কালাম বলেন, অনেক যোগ্য লোক থাকার পরেও সমাজসেবায় যে অপরিচিত মানুষটিকে রাষ্ট্র সর্ব্বোচ্চ পদকের জন্য মনোনীত করেছে তা সঠিক হয়নি। সমাজসেবায় মানুষটির ভূমিকার কথা কেউ জানে না। তার নাম শুনে সবাই বিস্মিত হয়েছে।
বুধবার ময়মনসিংহ প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয় ময়মনসিংহের সচেতন সমাজের ব্যানারে। সেখানে নাগরিক নেতা, শিক্ষক, আদিবাসী নেতারা উপস্থিত হন। এসময় বক্তারা তালিকা থেকে অরন্যের নাম বাতিলের দাবি জানান।
স্থানীয় ভাবে মতানৈক্য তৈরি হলেও অরন্য চিরান দাবি করেন, আমাকে সবাই চিনবে বিষয়টি এমন নয়। আমি বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছি। সরকার ও বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে তৃণমূল মানুষ ও আদিবাসীদের সেতু বন্ধন করে তাদের কল্যাণে কাজ করছি। এলাকার রোগীরা হাসপতালে আসলে তাদের পাশে থেকেছি, রক্ত জোগাড় করে দিয়েছে। আদিবাসীদের ভূমি ও পারিবারিক বিরোধ নিষ্পত্তি করতে সালিশ করে সমাধান করেছি। ঝড়ে পড়া শিক্ষার্থীদের পুনরায় স্কুল-কলেজে ফেরাতে উৎসাহ দিয়েছি।
মানববন্ধনে দাঁড়িয়ে সমতল আদিবাসীদের সংগঠন ট্রাইবাল ওয়েল ফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন ময়মনসিংহ সদর শাখার সভাপতি বিপুল হাজং বলেন, অরন্য চিরান এনজিওকর্মী ব্যতিত কিছু নন, তিনি এলাকাতেও এমন কোনো প্রতিষ্ঠান গড়েননি যা সমাজ সেবায় অবদান রেখেছে। বরং অরন্য চিরানের বিরুদ্ধে আদিবাসী সমাজের বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। স্বাধীনতা পুরস্কারে মহান ব্যক্তিদের নাম থাকলেও আমরা চাই না দুর্নীতিবাজ অরন্যের নাম থাকুক। পুরস্কারের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে পুরস্কার থেকে তার নাম বাতিল করা হোক, তা না হলে আমরা লজ্জিত হবো।
ময়মনসিংহ মহানগর সুজনের সম্পাদক আলী ইউসুফ বলেন, ইতোপূর্বে যারা স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন তাদের নামের পাশে যদি অরন্য চিরানের নাম থাকে তাহলে তাদের অমর্যাদা করা হবে। আমরা মনে করছি এটি একটি ভুল হয়েছে। এর আগে ২০২০ ও ২০২২ সালেও এরকম ভুল হয়েছিল, পরে সংশোধন করা হয়। এবছরও অরন্য চিরানের নামটি বাতিল করে নতুন তালিকা প্রকাশ করা হোক।
তিনি আরও বলেন, অরন্য সমাজসেবায় ময়মনসিংহ কিংবা দেশে এমন কোনো অবদান রাখেননি যার কারণে স্বাধীনতা পুরস্কার অর্জন করতে পারেন। আমরা তদন্তের দাবি জানাচ্ছি, কীভাবে তিনি পদকের জন্য মনোনীত হলেন এবং তাকে তালিকাভুক্ত করায় যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থার দাবি জানাচ্ছি।
ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদের সম্পাদক স্বাধীন চৌধুরী বলেন, স্বাধীনতা পুরস্কার এমন একজন ব্যক্তিকে দেওয়া হচ্ছে যা খুবই দুঃখজনক। তার এমন কোনো অর্জন নেই যা ইতিবাচক কোনো বার্তা দেয়। প্রশ্নহীন ভাবে বলতে পারি এটি একটি ভুল সিদ্ধান্ত। এমন হতে পারে কোনো ভাবে প্ররোচিত হয়ে পদক কমিটির লোকজন অন্যায় সিদ্ধান্তে তালিকাভুক্ত করেছেন। তালিকা থেকে অরন্যের নাম বাতিলের দাবি জানান তিনি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ মতিউর রহমান একাডেমি স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক মো. ফরিদুল ইসলাম লিপু বলেন, স্বাধীনতা পুরস্কারের মতো এতো বড় পুরস্কারে বিতর্কিত অরন্য চিরানের নাম বাতিলের দাবি জানাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই বিতর্কিত লোকটির নাম পরিবর্তন করে যোগ্য লোককে পুরস্কারটি দেওয়া হোক।
এর আগে সমতল আদিবাসীদের জাতীয় সংগঠন ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের একাংশের চেয়ারম্যান সুবাস চন্দ্র বর্মণ মন্ত্রী পরিষদ সচিব বরাবর একটি লিখিত আবেদন করে অরন্য চিরানের কর্মকাণ্ড ও তার স্বাধীনতা পদক বাতিলের দাবি জানান। ১৭ মার্চ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে দাবি সম্বলিত আবেদনটি জমা দেন আদিবাসী নেতারা।
- বিষয় :
- মানববন্ধন
- স্বাধীনতা পদক