বৈদ্যুতিক শকে মাছ শিকার, হুমকিতে জীববৈচিত্র্য

গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীর বারাশিয়া নদীতে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে মাছ শিকার করা হচ্ছে সমকাল
সাদেক আহমেদ, কাশিয়ানী (গোপালগঞ্জ)
প্রকাশ: ২৯ মার্চ ২০২৪ | ২৩:০৯ | আপডেট: ৩০ মার্চ ২০২৪ | ১১:২৭
গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার বারাশিয়া নদী ও মধুমতী বাঁওড়সহ নদীনালা, খালবিলে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে মাছ নিধন করা হচ্ছে। কিছু পেশাদার জেলে সহজে বেশি মাছ শিকারের আশায় এই পদ্ধতি ব্যবহার করে মাছ শিকার করছেন। এতে দেশীয় মাছের উৎপাদন কমে যাওয়ার পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে।
সাধারণ জেলেদের অভিযোগ, কিছু জেলে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে মাছ ধরার কারণে নদী, খাল ও বাঁওড়ে থাকা মাছের পোনা, ডিমসহ অন্যান্য জলজপ্রাণীও মারা পড়ছে। এ কারণে উপজেলার বারাশিয়া নদী, মধুমতী বাঁওড়সহ খালবিলে জাল ফেলে আগের মতো মাছ পাচ্ছেন না। তারা অবিলম্বে বৈদ্যুতিক শকসহ অবৈধ পদ্ধতিতে মাছ শিকারিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
কাশিয়ানী উপজেলা মৎস্য অফিসের তথ্যমতে, বৈদ্যুতিক শক ও চায়না ফাঁদে মাছ শিকারের কারণে উপজেলায় মৎস্য আহরণ কমেছে। ২০২২ সালে উপজেলার নদী, খালবিলে মোট ৮৪৭ টন মাছ পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু ২০২৩ সালে উৎপাদন প্রায় ৩০ শতাংশ কমে ৫৮৭ টনে এসে দাঁড়িয়েছে। এতে উপজেলার পাঁচ হাজার জেলে পরিবারের জীবিকা নির্বাহ কঠিন হয়ে পড়েছে।
উপজেলার সাধুহাটী গ্রামের এক জেলে জানান, বৈদ্যুতিক শক দিয়ে মাছ ধরতে আগ্রহী জেলের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এ পদ্ধতিতে জেলেরা নৌকায় ইজিবাইকে ব্যবহৃত ব্যাটারি সঙ্গে নেন। সেই ব্যাটারির সঙ্গে একটি ইনভার্টার (ব্যাটারির বৈদ্যুতিক শক্তি কমবেশি করার যন্ত্র) যুক্ত করা হয়। সেই ইনভার্টার থেকে দুটি তার বের করে একটি পানিতে ফেলে দেওয়া হয়। অপর তারটি একটি জালির সঙ্গে যুক্ত থাকে। বিদ্যুতায়িত ওই জালি যখন নদীর পানিতে ফেলা হয় তখন জালির ৫-৭ ফুট দূরত্বের মধ্যে থাকা মাছগুলো কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ভেসে ওঠে। ভেসে ওঠা মাছগুলো পরে জালি দিয়ে নৌকায় তোলা হয়। এ পদ্ধতিতে মাছ শিকারে সাপ-ব্যাঙসহ অন্যান্য জলজপ্রাণীও মারা পড়ে।
রসিক বালা, তারা বিশ্বাস, দীপক ঠাকুরসহ কয়েকজন স্থানীয় জেলে বলেন, বর্ষা মৌসুমে এখন পানি কম হওয়ায় নদী-নালায় এমনিতেই মাছ কমে গেছে। তার ওপর বৈদ্যুতিক শক দিয়ে মাছ শিকার করায় এখন দেশীয় মাছ নদী, খালবিলে নেই বললেই চলে। তারা জানান, বৈদ্যুতিক শক, কারেন্ট জাল ও চায়না ফাঁদে মাছ শিকারের কারণে মাছের পোনা ও ডিম নষ্ট হচ্ছে। এতে সাধারণ জেলেদের জীবিকা নির্বাহে সমস্যা হচ্ছে। সাধারণ জাল দিয়ে মাছ ধরে অনেক জেলে দিনে পাঁচশ টাকার মাছও ধরতে পারছেন না। এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে নদী, খালবিলে, হাওর-বাঁওড়ে আর কোনো মাছই থাকবে না। এসব মাছ শিকারিকে আইনের আওতায় আনা না হলে সাধারণ জেলেদের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।
নাম না প্রকাশের শর্তে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে মাছ শিকারি দুই জেলে জানান, বৈদ্যুতিক শকে মাছ শিকারে সাধারণত দুই ধরনের ব্যাটারি ব্যবহার হয়। বড় আকারের ব্যাটারির ওজন ২০ কেজির বেশি ও মূল্য প্রায় ১ লাখ টাকা। সাধারণত নদীতে মাছ শিকারে এই ব্যাটারি ব্যবহার করা হয়। এতে ২০ থেকে ৪০ ফিট ব্যাসার্ধের মধ্যে থাকা জলের সব প্রাণী মারা যায়। খালবিলে মাছ শিকারে সাধারণত ছোট ব্যাটারি ব্যবহার করা হয়। ৮-১০ কেজি ওজনের এই ছোট ব্যাটারিতে পাঁচ-সাত বর্গফুট ব্যাসার্ধের মধ্যে পানির সব প্রাণী ধরা পড়ে যায়। এসব ব্যাটারি ২০ হাজার টাকা থেকে ৪০ হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া যায়। বিলে বা খালে নির্ভয়ে মাছ ধরতে পারলে এসব ব্যাটারিতে প্রচুর মাছ ধরা সম্ভব। এতে ১৫-২০ দিনের মধ্যে ব্যাটারির দাম উঠে আসে। তবে প্রশাসনের ভয়ে তারা লুকিয়ে এ পদ্ধতিতে মাছ শিকার করেন।
কাশিয়ানী উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা রাজীব রায় জানান, উপজেলার বিভিন্ন স্থানে কিছু অসাধু জেলে গভীর রাতে নদীতে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে মাছ শিকার করছে। তাদের চেষ্টা করেও আটক করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে তাদের শনাক্ত করতে গোয়েন্দা তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। পুলিশেরও সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।
কাশিয়ানী উপজেলা স্বাস্থ্যও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মাহমুদুল হাসান বলেন, বৈদ্যুতিক শক দিয়ে ধরা মাছ খাওয়া স্বাস্থ্যসম্মত কিনা– এ বিষয়ে এখনও কোনো ধরনের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়নি।
কাশিয়ানী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ রাশেদুজ্জামান বলেন, বিষয়টি নিয়ে জেলা সমন্বয় কমিটির সভায় আলোচনা হয়েছে। বৈদ্যুতিক শক দিয়ে মাছ শিকারিদের দ্রুতই আইনের আওতায় আনা হবে।