উখিয়ায় পাহাড় সাবাড়ে মিত্র আ’লীগ-বিএনপি

ফাইল ছবি
চট্টগ্রাম ব্যুরো ও কক্সবাজার প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০২ এপ্রিল ২০২৪ | ০০:৫৪ | আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০২৪ | ১২:২৩
কক্সবাজারের উখিয়ায় পাহাড় ধ্বংসে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা জোট গড়েছেন। তারা প্রতিদিন প্রশাসনকে ম্যানেজ করে পাহাড় কেটে মাটি ছাড়াও নদী-ঝিরির বালু, বনের গাছ পাচারে তিন শতাধিক অবৈধ ডাম্প ট্রাক চালাচ্ছেন। সর্বশেষ গত রোববার ভোর রাতে বন কর্মকর্তা মো. সাজ্জাদুজ্জামান পাহাড়ের মাটি কাটা বন্ধে অভিযানে গেলে তাঁকে ডাম্পচাপা দিয়ে হত্যা করা হয়। এ নিয়ে গত দুই বছরে ডাম্পচাপায় প্রাণ গেল ১০ জনের।
স্থানীয় সূত্র জানায়, রাজনৈতিক বিরোধ থাকলেও উখিয়ায় পাহাড় কাটতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাকর্মীর মধ্যে রয়েছে দারুণ সখ্য। বেশির ভাগ ডাম্প ট্রাকের মালিক দল দুটির নেতারা। তারাই হাইওয়ে, ট্রাফিক পুলিশ ও বন বিভাগকে প্রতি মাসে ডাম্পারপ্রতি ৫০০ টাকা চাঁদা দেন। প্রশাসনের টাকা নেন তাদের প্রতিনিধি আনোয়ার হোসেন। রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে ডাম্প ট্রাকের মালিক-চালকরা বেপরোয়া। কেউ প্রতিবাদ করলে তাঁকে হত্যা করতেও দ্বিধা করে না তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উখিয়ায় অবাধে অবৈধ ডাম্প ট্রাক চলতে পারছে রাজাপালং ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মুফিজুর রহমান ও ইদ্রিস মিয়ার দাপটে। দু’জনই আবার ডাম্পার মালিক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। তাদের সঙ্গে আছেন ঘুমধুম ইউনিয়ন শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক হেমলাল বড়ুয়া, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা নুর হোসেন, মং ছানু, নুর মোহাম্মদ, মো. আলমগীর, সেলিম উল্লাহ বাহাদুর, বেলাল উদ্দিন ও ইব্রাহিম। পাহাড় নিধনে রয়েছেন উখিয়া উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ আরাফাত চৌধুরীও। সমকালের সঙ্গে আলাপকালে নেতারা মাটি-বালু ব্যবসায় যুক্ত থাকলেও পাহাড় কাটা নিয়ন্ত্রণ করছেন না বলে দাবি করেন।
পরিবেশ সাংবাদিক ফোরাম কক্সবাজারের সাধারণ সম্পাদক ইরফান উল হাসান বলেন, ডাম্প ট্রাকে মাটি ও বালু পাচারের মাধ্যমে সংরক্ষিত পাহাড় ধ্বংস ও বনাঞ্চল উজাড় করা হচ্ছে। হাইওয়ে ও ট্রাফিক পুলিশ এবং বন বিভাগকে ম্যানেজ করে এসব ডাম্প ট্রাক চালাচ্ছেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা।
উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল হুদা বলেন, ‘রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ডাম্প ট্রাক মালিক ও চালকরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। প্রশাসন কঠোর হলে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যেত। কিন্তু বাস্তবতা হলো পরিবেশ ধ্বংসের অবৈধ কাজে তাদেরও প্রশ্রয় রয়েছে।’
সরেজমিন গতকাল সোমবার উখিয়া রাজাপালং ইউনিয়নের হরিণমারা এলাকা ঘুরে একাধিক পাহাড়ে এক্সক্যাভেটর দেখা যায়। দিনেই মাটি কেটে অসংখ্য ডাম্প ট্রাকে অন্যত্র নেওয়া হচ্ছে। পাহাড় কাটার কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের বেশির ভাগই রোহিঙ্গা। রবি আলম নামের এক শ্রমিক জানান, দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরিতে কুতুপালং ক্যাম্প থেকে এসে তারা কাজ করছেন। রোহিঙ্গা মাঝি আলতাফ তাদের কাজ দিয়েছেন। ডাম্পচালক আল-আমিন বলেন, ‘প্রতি গাড়ি মাটি ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকায় ইটভাটায় দেওয়া হয়।’
জানা গেছে, উখিয়ায় ডাম্প ট্রাক নির্বিঘ্নে চলাচলে কয়েক বছর আগে মালিকদের নিয়ে ‘ডাম্পার মালিক সমিতি’ করা হয়। এ সংগঠনের সভাপতি আওয়ামী লীগ নেতা মুফিজুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক ইদ্রিস মিয়া এলাকায় প্রভাবশালী। তবে এখন এতে যুক্ত হয়েছেন ঘুমধুম ইউনিয়ন শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক হেমলাল বড়ুয়া। একইভাবে উখিয়ার মরিচ্যা এলাকায় ডাম্পার শ্রমিক সমিতির নেতৃত্বে আছেন বেলাল উদ্দিন। আবার কোটবাজার এলাকায় ডাম্পার নিয়ন্ত্রক উখিয়া উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ আরাফাত চৌধুরী। তিনি আবার কোটবাজার সিএনজিচালিত অটোমালিক সমিতিরও সভাপতি। জানতে চাইলে আরাফাত চৌধুরী সমকালকে বলেন, ‘আমার কোনো ডাম্প ট্রাক নেই, নিয়ন্ত্রণ করার প্রশ্নই আসে না।’
শ্রমিক লীগ নেতা হেমলাল বড়ুয়া বলেন, ‘আমার একটি ডাম্পার চলে। আমি কোনো ডাম্পার থেকে চাঁদা নিই না, ব্যবসাতেও নেতৃত্ব দিই না।’
ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি মুফিজুর রহমান সমকালকে বলেন, ‘শুরুতে আমার সংগঠনে ৩০-৩৫টি ডাম্পার থাকলেও এখন কমে গেছে। নতুন নেতৃত্ব আসায় আমার ট্রাক বিক্রি করে দিয়েছি।’ বেলাল উদ্দিন বলেন, ‘আমি ডাম্পার নয়, ডাম্পার শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ করি।’
ভাগ পায় পুলিশ ও বন বিভাগ
উখিয়ার পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরীর অভিযোগ, তাঁর ইউনিয়নে অন্তত ১০টি পাহাড়ে ড্রেজার এবং খাল ও ঝিরিতে পাম্প মেশিন বসিয়ে কয়েক হাজার ঘনফুট বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। প্রতিদিন শতাধিক ডাম্প ট্রাকে পাহাড়ের মাটি ও বালু পাচার হচ্ছে। প্রতি ট্রাক মাটি ও বালু বিক্রি হয় ১ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকায়। সরকারি দপ্তরকে মাসোহারা দেয় বলে এসব ডাম্প ট্রাককে কেউ বাধা দেয় না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ডাম্প ট্রাকের মালিক বলেন, প্রতি মাসে ট্রাকপ্রতি প্রশাসনকে ৫০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। চাঁদার টাকা তুলে প্রশাসনের হাতে পৌঁছে দেন আনোয়ার হোসেন।
তবে চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে শাহপরী থানা হাইওয়ে পুলিশের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নাজমুল হাসান বলেন, অবৈধ ডাম্প ট্রাক বন্ধে আমরা নিয়মিত অভিযান চালাই। হাইওয়ে পুলিশের নামে কেউ টাকা নিচ্ছে কিনা, তা জানি না। ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক আমজাদ হোসেন বলেন, ডাম্প ট্রাকের দৌরাত্ম্য শহরের বাইরে বেশি। গত কয়েক মাসে বালু নিয়ে শহরে ঢোকার সময় অন্তত ৫০টি ডাম্পার জব্দ করা হয়েছে।
বন বিভাগ বলছে, গত এক বছরে পাহাড় কাটার অভিযোগে অন্তত ১৯টি অবৈধ ডাম্প ট্রাক জব্দ করে মামলা দেওয়া হয়েছে। বন রক্ষায় অভিযানে গিয়ে তাদের কর্মকর্তা সাজ্জাদুজ্জামান প্রাণ দিয়েছেন।
কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা (ডিএফও) সারোয়ার আলম বলেন, কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় দেড় হাজারের বেশি অবৈধ ডাম্প ট্রাক রয়েছে। শুধু উখিয়ায় আছে তিন শতাধিক।
এদিকে উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়নের হরিণমারা এলাকায় ডাম্পারচাপায় বন কর্মকর্তা সাজ্জাদুজ্জামান (৩০) নিহতের ঘটনায় রোববার রাতে মামলা করেছেন বন বিভাগের উখিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা গাজী শফিউল আলম। এতে ১০ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতপরিচয়ের ৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছেন উখিয়া থানার ওসি শামীম হোসাইন।
- বিষয় :
- পাহাড় কাটা
- উখিয়া
- আওয়ামী লীগ
- বিএনপি