রুমা-থানচি থমথমে, রাতে থানায় হামলা, গোলাগুলি
ব্যাংক ডাকাতি

বান্দরবানের থানচিতে বৃহস্পতিবার রাতে পুলিশের সতর্ক অবস্থান -সংগৃহীত
আহমেদ কুতুব, রুমা (বান্দরবান) থেকে
প্রকাশ: ০৫ এপ্রিল ২০২৪ | ০১:১৭ | আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০২৪ | ০৬:৩৯
অপহৃত সোনালী ব্যাংক ব্যবস্থাপক নেজাম উদ্দিনকে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বান্দরবানের রুমা বাজার থেকে উদ্ধারের পর রাতে থানচি উপজেলা সদরে ব্যাপক গোলাগুলির খবর পাওয়া গেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাত ৯টার দিকে এক দল সশস্ত্র সন্ত্রাসী থানচি বাজারে এসে গুলি শুরু করে। পরে তারা থানায় গুলি চালায়। পুলিশ ও বিজিবি পাল্টা গুলি করে। এ সময় অন্তত ৫০০ রাউন্ড গুলি ছুড়েছে পুলিশ। হাসপাতালের পেছন দিকেও গুলি হয়েছে। থানচি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মামুন গত রাতে গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মধ্যেই ফের এই গোলাগুলির ঘটনা ঘটল। থানচিতে গত রাতের গুলির ঘটনায় পাহাড়ের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) তরফ থেকে তাদের ফেসবুক পেজে পোস্ট দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা মো. হাবিব থানচি বাজার থেকে সেখানকার পরিস্থিতির কয়েক সেকেন্ডের একটি ভিডিও ফেসবুকে শেয়ার করেন। সেখানে কয়েকজনকে আতঙ্কিত কণ্ঠে কথা বলতে শোনা গেছে। সেই সঙ্গে মুহুর্মুহু গুলির শব্দ।
এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘থানচিতে গোলাগুলির বিষয়টি আমরা জেনেছি। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে কাজ করছি।’
চট্টগ্রামের ডিআইজি নূরে আলম মিনা বলেন, ‘থানচি পাহাড়ের পূর্ব ও দক্ষিণ দিক থেকে থানা লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে কেএনএফ সন্ত্রাসীরা। পরে পুলিশ থানা থেকে গুলি করে। বাজারে পুলিশের টহল টিম ছিল। তারা সন্ত্রাসীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছে। এর পর সেনাবাহিনী ও বিজিবি পুলিশের সঙ্গে যোগ দেয়। পরিস্থিতি থমথমে। পুলিশ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে।’
থানচি থানার ওসি জসীম উদ্দিন বলেন, সন্ত্রাসীদের সঙ্গে ৫০০ রাউন্ড গোলাগুলি হয়। এক ঘণ্টা গোলাগুলি চলেছে। বিজিবি ও পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।
এদিকে রুমায় গতকাল দুপুরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কেএনএফের গোলাগুলি হয়েছে। রুমা থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে মুননুয়াম, আর্থা ও বাসলাংপাড়ায় এ ঘটনা ঘটে। গোলাগুলির মুখে টিকতে না পেরে কেএনএফ সদস্যরা পালিয়ে যায়।
চারদিকে ভীতি
চারপাশে ১৫০ পুলিশ, মাঝখানে নারায়ণ দাশ। তবু তাঁর চোখেমুখে ভয়ের ছাপ। বান্দরবানের রুমা শাখা সোনালী ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপক তিনি। বৃহস্পতিবার পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি নূরে আলম মিনা ডাকাতি হওয়া ব্যাংকটির শাখা পরিদর্শনে গেলে তাঁর সঙ্গেই ছিলেন ভয়ার্ত এ ব্যাংকার। ডাকাতদের তছনছ করা বিভিন্ন কক্ষ পুলিশ কর্মকর্তাদের ঘুরিয়ে দেখান তিনি। শুধু নারায়ণ নন; ব্যাংকের কর্মচারী থেকে শুরু করে রুমা উপজেলা প্রশাসনে কর্মরত সবাই কেএনএফ সদস্যদের ভয়ে চুপসে গেছেন। মুখে কুলুপ এঁটেছেন; রা করছেন না কেউ।
রুমার মতো অভিন্ন ছবি থানচি সদরেও। সেখানে সোনালী ব্যাংক এবং কৃষি ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। উপজেলা সদরে ব্যবসায়ীরা দোকানপাট খুললেও কেউ কোনো কথা বলছেন না। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বাস চলাচল এক রকম বন্ধই ছিল। দুপুরের পর বাসসহ যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়। এদিকে অপহৃত সোনালী ব্যাংক ব্যবস্থাপক নেজাম উদ্দিনকে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে রুমা বাজার থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।
এদিকে দিনদুপুরে খোদ উপজেলা সদরে খাকি পোশাক পরে গুলি করতে করতে ব্যাংক ডাকাতি করে নিরাপদে চলে যাওয়ার পর প্রশাসনের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যেখানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিসের ১০০ গজের মধ্যে ব্যাংক ডাকাতি, পুলিশ-আনসারের অস্ত্র লুটের ঘটনায় প্রশাসনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা অপ্রতুল ছিল– তা প্রশ্নাতীত। গত মঙ্গল ও বুধবার রুমা এবং থানচির দুটি ব্যাংকের তিনটি শাখায় ডাকাতি ও সরকারি অস্ত্র লুটের ঘটনা ঘটলেও থানায় এখনও মামলা হয়নি। তবে সন্ত্রাসী তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে রাখতে দুই উপজেলায় যৌথ বাহিনী অভিযান শুরু করেছে। রুমা, থানচি ও রোয়াংছড়ির সোনালী ব্যাংক এবং কৃষি ব্যাংকের কার্যক্রম নিরাপত্তাজনিত কারণে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে।
সরেজমিন বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে রুমা উপজেলা সদরে ঢুকতেই সড়কের মোড়ে মোড়ে সতর্ক অবস্থায় দেখা যায় আর্মড পুলিশ সদস্যদের। সড়কে কিছুক্ষণ পরপর সেনাবাহিনী ও বিজিবির গাড়ি টহল দেয়। রুমা উপজেলা প্রশাসন কার্যালয়ে ঢুকতেই ত্রিমুখী সড়কের মুখে পাহাড়ের চূড়ায় চোখে পড়ে সোনালী ব্যাংকের রুমা শাখা। সেই শাখার সামনে চারদিক অর্ধশত পুলিশ সদস্য ঘিরে রয়েছে। ভেতরে তখন চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি নূরে আলম মিনা ব্যাংকটির তছনছ করা কক্ষগুলো পরিদর্শন করছিলেন। পরে তিনি থানচি গিয়ে সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংক পরিদর্শনে যান।
চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি নূরে আলম মিনা বলেন, এজাহার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এজাহার ক্রটিপূর্ণ হলে ভবিষ্যতে মামলা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই মামলা প্রফেশনালি করার জন্য একটু সময় লাগছে। সেনাবাহিনী, বিজিবি, র্যাবের সঙ্গে সমন্বয় করে একটি টিমওয়ার্কের মাধ্যমে কাজ করব। এ ঘটনার পেছনে কারা কারা রয়েছে– চিহ্নিত করে আমরা আইনের আওতায় নিয়ে আসতে পারব। ডাকাতরা হঠাৎ হামলা করেছে। বিদ্যুৎ বন্ধ করে পরিকল্পিতভাবে ডাকাতি করেছে। সামনে ঈদ, তাই বেতন-বোনাসের কারণে টাকা বেশি ছিল। লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে কাজ চলছে। সন্ত্রাসীদের ধরতে শিগগিরই যৌথ অভিযান চালানো হবে।
বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন বলেন, পুলিশ, সেনাবাহিনীসহ সবাই তাদের মতো অভিযান কার্যক্রম চালাচ্ছে। কৌশলগত কারণে আমরা এখনই সবকিছু বলতে চাইছি না।
সোনালী ব্যাংক বান্দরবান অঞ্চলের ডিজিএম উসমান গনি বলেন, নিরাপত্তা-শঙ্কার কারণে আমরা ডাকাতি হওয়া রুমা, থানচি ও রোয়াংছড়ি শাখার কার্যক্রম বন্ধ রেখেছি। এ তিনটি শাখার কার্যক্রম বান্দরবান জেলা সদর শাখার মাধ্যমে চালিয়ে নিচ্ছি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ফের সেখানে কাজ শুরু হবে।
রুমা সোনালী ব্যাংক শাখার দ্বিতীয় কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপক) নারায়ণ দাশ বলেন, ঘটনার সময় ব্যাংকে কেউ ছিল না। আমি বাসায় ছিলাম। ব্যবস্থাপক নেজাম স্যার নামাজে ছিলেন। এসে দেখি, ডাকাতরা স্যারকে নিয়ে গেছে।
শর্ষেই ভূত!
ব্যাংক ডাকাতিতে কেএনএফের নাম এলেও তাদের শিকড় এখন অনেক গভীরে। রুমায় সোনালী ব্যাংক, বিদ্যুৎ অফিসে কুকি-চিনের সমর্থনপুষ্ট কর্মচারী পরোক্ষভাবে ডাকাতির ঘটনায় সহযোগিতা করেছে বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। দুটি ব্যাংকের কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলেও সন্দেহজনক তথ্য মিলেছে।
সোনালী ব্যাংকের এক কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমি ঘটনার সময় ব্যাংকে ছিলাম না। সকাল থেকে অফিসের কাজ শেষ করে বেথলেমপাড়ার বাসায় চলে যাই।’ বেথলেমপাড়ায় কুকি-চিনের ‘হেডকোয়ার্টার’বলে লোকমুখে প্রচার রয়েছে। রুমা বিদ্যুৎ অফিসের আরেক কর্মচারী বলেন, ‘আমি রুমার স্থায়ী বাসিন্দা হলেও ঘটনার সময় কুকি-চিনের দুই সদস্য আমার মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে উপজেলার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এ ঘটনায় আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।’ রুমার মতো একই অবস্থা থানচি সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংক শাখায়ও ঘটেছে বলে গোয়েন্দা সংস্থার সন্দেহ। তিনটি ব্যাংকে কর্মরত বম জনগোষ্ঠীর কর্মচারীরা কুকি-চিনের কাছে ব্যাংকে কত টাকা আছে, সে তথ্য পাচার করেছে।
কুকি-চিনকে কঠোরভাবে দমনের প্রত্যয়
বান্দরবানে ব্যাংক লুটের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি বলেন, ব্যাংকে ডাকাতি ছোট ঘটনা হিসেবে দেখা হচ্ছে না। কুকি-চিনকে কঠোরভাবে দমনে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী এ কথা জানান।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে ডাকাতি, অস্ত্র লুট ও সোনালী ব্যাংক ব্যবস্থাপককে অপহরণের মতো ঘটনা যারা ঘটিয়েছে, তাদের শাস্তি হবে। তিনি বলেন, কেন হঠাৎ তারা এমন ঘটনা ঘটিয়েছে, তা আমাদের জানা ছিল না। তবে যে উদ্দেশ্যেই তারা এসব করুক না কেন; আমরা তাদের কাউকে ছাড় দেব না। আর এমন কিছু ঘটেনি, যাতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে হবে। আমরা দেখছি, ব্যবস্থা নিচ্ছি। মন্ত্রী বলেন, এর পেছনে কারা আছে, কোনো উদ্দেশ্য আছে কিনা, কোনো ধরনের নাশকতা কিংবা অন্য কোনো পরিকল্পনা রয়েছে কিনা, সেগুলো দেখে ব্যবস্থা নেব।
- বিষয় :
- ব্যাংক ডাকাতি
- কেএনএফ
- হামলা
- গোলাগুলি