সুনসান বৃষ্টির বাড়ি, বারবার কবরে ছোটেন মা

এই সিঁড়ি দিয়েই ঘরে ঢুকতেন বৃষ্টি খাতুন। সেখানেই রাজ্যের শূন্যতা নিয়ে কাঁদছিলেন মা বিউটি খাতুন। রোববার দুপুরে খোকসার বনগ্রাম পশ্চিমপাড়ায়। ছবি: সমকাল
মুনসী লিটন, খোকসা (কুষ্টিয়া)
প্রকাশ: ০৮ এপ্রিল ২০২৪ | ২২:৪২ | আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০২৪ | ০৮:৩২
সাবলুল আলম সবুজ শেখ ও বিউটি খাতুন দম্পতির তিন মেয়ে। ছেলের অভাব অনুভব করেননি তারা। যে কারণে একই আদরে বড় করেছেন মেয়েদের। বড় স্বপ্ন ছিল এ দম্পতির চোখে। রাজধানীর বেইলি রোডে ২৯ ফেব্রুয়ারির ভয়াবহ আগুনে পুড়ে প্রাণ যায় তাদের বড় মেয়ে বৃষ্টি খাতুনের। সেই সঙ্গে সব স্বপ্ন পুড়ে যায় বিউটি খাতুনের।
রোববার দুপুরে কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার বেতবাড়িয়া ইউনিয়নে ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বনগ্রাম পশ্চিমপাড়ার বাড়িতে বসেছিলেন বিউটি। আধাপাকা ঘরের সিঁড়িতে তাঁকে দেখা গেলেও ঝাপসা দৃষ্টি ছিল ৫০ গজ দূরে। যেখানে চাচার কবরের পাশে চিরনিদ্রায় বিউটির আদরের ধন বৃষ্টি। যে সিঁড়ি দিয়ে ঈদের ছুটিতে বৃষ্টি বাড়ি ফিরতেন বাবা সবুজ শেখের সঙ্গে, সেই সিঁড়িতে বসে অনেক সময় কাটান বিউটি। সদালাপী এই মানুষটি যেন শোকে পাথর হয়ে গেছেন। কারও সঙ্গে খুব বেশি কথা বলেন না।
এসব তথ্য জানান বৃষ্টির চাচি সুইটি বেগম। তিনি বলেন, সুযোগ পেলেই মেয়ের কবরের কাছে ছুটে যান বিউটি। চিৎকার করে কাঁদেন। সেখান থেকে ঘরে ফেরাতে দুই-তিনজনের ঘাম ঝরে। রোববার সকালেও ছুটে গিয়েছিলেন কবরের কাছে।
প্রতিবেশী রেখা বলেন, আগে সবার খোঁজখবর নিতেন বিউটি খাতুন। এখন মেয়ের শোকে পাথর। কারও সঙ্গে কথায় আগ্রহ নেই। একা একা থাকেন। সুযোগ পেলেই মেয়ের কবরের পাশে ছুটে যান। ধরে আনতে হয়।
বিউটিকে চোখে চোখে রাখাই এখন অন্য দুই মেয়ে কলেজছাত্রী ঝর্ণা খাতুন আর স্কুলছাত্রী বর্ষা খাতুনের প্রধান কাজ। প্রতিবেশীদের অনেকেই পালা করে তাঁকে সময় দেন। তবু সুযোগ পেলেই বৃষ্টির কবরের দিকে ছুটে যান। ঈদুল ফিতরের মাত্র একদিন বাকি। অথচ নতুন পোশাক বা সেমাই-চিনি, কিছুই কেনা হয়নি। এই পরিবারে ঈদের কোনো আয়োজন নেই।
বিউটি খাতুন কাঁদতে কাঁদতে বলেন, সব স্বপ্নই তো আগুনে পুড়ে গেছে। আর কী হবে? কী ভালো হবে, আর কীসেই বা মন্দ হবে? তাঁর আবার কীসের ঈদ– এমন প্রশ্ন ছুড়ে দেন।
পারিবারিক সূত্র জানায়, বৃষ্টি খাতুন বনগ্রাম পশ্চিমপাড়া উপানুষ্ঠানিক প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ২০০৯ সালে প্রাথমিক সমাপনী পাস করেন। ২০১০ সালে তিনি ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন বনগ্রাম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। ওই বিদ্যালয় থেকে বাণিজ্য বিভাগ নিয়ে এসএসসি উত্তীর্ণ হন ২০১৫ সালে। একই বিভাগ নিয়ে কুষ্টিয়া সরকারি গার্লস কলেজ থেকে ২০১৭ সালে এইচএসসি পাসের পর ২০১৮ সালে ইডেন মহিলা কলেজে দর্শন বিভাগে ভর্তি হন। তবে দুটি সেমিস্টারে অংশ নেওয়ার পর অনিয়মিত হয়ে পড়েন। অনলাইন সংবাদমাধ্যম দ্য রিপোর্টে ডটলাইভে অভিশ্রুতি শাস্ত্রী নামে শিক্ষানবিশ সংবাদকর্মী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ওই প্রতিষ্ঠানের কাজ ছেড়ে দেন। নতুন একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরুর কথা ছিল। ২৯ ফেব্রুয়ারি এক বন্ধুর সঙ্গে বৃষ্টি রাতের খাবার খেতে যান রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজের একটি রেস্তোরাঁয়। সেখানে ভয়াবহ আগুনে ৪৬ জন মারা যান। তাদের একজন বৃষ্টি। তবে অভিশ্রুতি শাস্ত্রী নাম নিয়ে রহস্য দেখা দেয়। পরে ডিএনএ টেস্টে পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর ১১ মার্চ দুপুরে বাবা সাবলুল আলম সবুজ শেখের কাছে তাঁর মরদেহ হস্তান্তর করা হয়।
বৃষ্টির চাচি সুইটি বেগম বলেন, সবুজ শেখ ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। মেয়ের দাফনের পর একবার বাড়ি এসেছিলেন তিনি। প্রতি ঈদের দুই-তিন দিন আগে মেয়েকে নিয়েই বাড়ি ফিরতেন। এবার এখনও আসেননি। হয়তো ঈদের একদিন আগে ফিরতে পারেন।
গতকাল সোমবার মোবাইল ফোনে সবুজ শেখ বলেন, এবার তো আর মেয়ে নাই। সব ম্যানেজ করে মঙ্গলবার গ্রামে ফিরবেন। ছোট দুই মেয়েকে ঈদ উপলক্ষে কেনাকাটার জন্য বলেছিলেন। কিন্তু তারা বলেছে, প্রয়োজন হলে জানাবে!
সুইটি বেগমের ভাষ্য, আত্মীয়স্বজন বা নিম্ন আয়ের পাড়া-প্রতিবেশীর শিশুদের ঈদের পোশাক কেনাকাটার দায়িত্ব নিতেন বৃষ্টি। এবার তাঁর শূন্যতা পরিবারের পাশাপাশি অন্যদেরও পোড়াচ্ছে।
- বিষয় :
- বেইলি রোডে আগুন
- কুষ্টিয়া