ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

প্রাথমিক ধারণা, বেপরোয়া গতিতে দুর্ঘটনা

পণ্যবাহী গাড়িতে যাত্রী অনিয়মের বলি ১৪ প্রাণ

ফরিদপুরে বাস পিকআপ সংঘর্ষ

পণ্যবাহী গাড়িতে যাত্রী অনিয়মের বলি ১৪ প্রাণ

ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার ছত্রকান্দা গ্রামে মঙ্গলবার নিহতদের স্বজনের আহাজারি। ইনসেটে কানাইপুরে বাসের সঙ্গে সংঘর্ষে দুমড়েমুচড়ে যাওয়া পিকআপ ভ্যান- সমকাল

 ফরিদপুর অফিস

প্রকাশ: ১৭ এপ্রিল ২০২৪ | ০০:৫২ | আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০২৪ | ০০:৫২

ঈদের আগে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, পণ্যবাহী যানে যাত্রী পরিবহন করা যাবে না। কিন্তু ঈদের আগে-পরে দেখা গেছে, বাড়তি ভাড়া ও বাস সংকটে লাখো মানুষ ট্রাক-পিকআপে চড়ছেন। তেমনই এক পিকআপ দুর্ঘটনায় ১৪ জন নিহত হয়েছেন। গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৮টার দিকে ফরিদপুরের কানাইপুরের তেঁতুলতলা দিকনগর এলাকায় কুদ্দুস মিয়ার ইটভাটার সামনে বাস ও পিকআপের এ সংঘর্ষ হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ইউনিক পরিবহনের বাসটি কোনো কারণে সড়কে আড়াআড়ি হয়ে যায়। তাতে ধাক্কা দেয় পিকআপ। এতে পিকআপের ১৬ যাত্রী সড়কে ছিটকে পড়েন। তাদের ১৪ জন নিহত হয়েছেন। চিকিৎসাধীন অপর দুই যাত্রীর অবস্থাও আশঙ্কাজনক। পিকআপচালকের কেবিন দুমড়েমুচড়ে যায় এবং তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান। বাসের কয়েকজন যাত্রীও আহত হয়েছেন। এদিকে একই দিনে আট জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন আরও ১১ জন।

ফরিদপুরের দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকীর নেতৃত্বে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছে ফরিদপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীর সমন্বয়ে গঠিত এ কমিটিকে আগামী তিন কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক কামরুল আহসান তালুকদার বলেছেন, আপাতদৃষ্টিতে চালকের অসতর্কতা ও একই লেনে দুটি গাড়ি চলে যাওয়ায় দুর্ঘটনা হয়েছে। সড়ক মেরামত ও সংস্কারের বিষয়ে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরকে (সওজ) পরিদর্শনের জন্য বলা হয়েছে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, সড়কের গর্তে চাকা পড়ে বাসটি আড়াআড়ি হয়ে যায়। তবে সড়কে খানাখন্দ থাকার অভিযোগ নাকচ করেছে সওজ।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক হাদীউজ্জামান সমকালকে বলেছেন, পিকআপ ও ট্রাকে যাত্রী পরিবহন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এসব যানবাহন যাত্রী পরিবহনের উপযোগী নয়। গতিশীল অবস্থায় সামান্য ধাক্কাতেও পেছন থেকে যাত্রী ছিটকে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা ঘটে।

 ফরিদপুরে ধাক্কা তীব্র হওয়ায় যাত্রীরা ছিটকে পড়ে প্রায় সবাই মারা গেছেন। তবে কী কারণে বাসের সঙ্গে পিকআপের ধাক্কা লেগেছে, তা তদন্ত ছাড়া বলা সম্ভব নয়। নিরাপত্তার স্বার্থেই পণ্যবাহী যানে যাত্রী পরিবহন বন্ধ করতে হবে।

সিদ্ধান্ত থাকার পরও কেন পণ্যবাহী যানে যাত্রী পরিবহন বন্ধ হচ্ছে না– এমন প্রশ্নে হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক শাহাবুদ্দিন খান সমকালকে বলেছেন, সচেতনতার অভাবে শতভাগ বন্ধ হচ্ছে না। ঈদের আগে যাত্রী বহনের সময় অনেক পণ্যবাহী গাড়ি আটকানো এবং মামলা দেওয়া হয়, যা ঈদের পরও চলছে। কিন্তু পুলিশের চোখ এড়িয়ে অনেকে যাত্রী তুলছেন। চালক ও যাত্রীর সচেতনতা ছাড়া এ সমস্যা শতভাগ নির্মূল সম্ভব নয়।

দুর্ঘটনায় নিহতরা হলেন ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার শেখর ইউনিয়নের ছত্রকান্দা গ্রামের রাকিব হোসেন মিলন (৪২), তাঁর স্ত্রী শামীমা ইসলাম সুমী (২৫), তাদের দুই ছেলে আলভি রোহান (৭) ও আবু সিনান (৪), প্রতিবেশী মৃত আবদুল ওহাবের স্ত্রী মর্জিনা বেগম (৭০), বোয়ালমারীর কুমরাইল গ্রামের ইকবাল শেখ (৩২), পিকআপচালক আলফাডাঙ্গা পৌরসভার কুসুমদী গ্রামের নজরুল মোল্ল্যা (৩৫), আলফাডাঙ্গা সদর ইউনিয়নের বেজিডাঙ্গা গ্রামের জাহানারা বেগম (৫০), তাঁর ভাতিজি প্রবাসীর স্ত্রী সোনিয়া বেগম (৩০), সোনিয়ার ১১ মাস বয়সী মেয়ে নুরানী, আলফাডাঙ্গা সদর ইউনিয়নের চরবাকাইল গ্রামের তবিবুর খান (৫৫), হিদাডাঙ্গা গ্রামের শুকুরন বেগম (৯০), তাঁর মেয়ে মনিরা বেগম সূর্য (৫৫) ও প্রতিবেশী কোহিনূর বেগম (৬০)।

নিহত মিলনের মা মনোয়ারা ওরফে হুরি বেগম (৬৫) এবং নিহত ইকবালের স্ত্রী পপি পারভীন (২৫) ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

মিলন সরকারের অর্থ বিভাগের লিফটম্যান। তিনি গ্রামের অন্যদের নিয়ে পিকআপে ফরিদপুরে ত্রাণ আনতে যাচ্ছিলেন বলে জানা গেছে।

ফরিদপুর ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক তুহিন লস্কর বলেন, ঢাকা থেকে চুয়াডাঙ্গাগামী উত্তরা ইউনিক পরিবহনের (মেট্রো-ব-১১-১৭৫৯) বাসের সঙ্গে আলফাডাঙ্গা থেকে ফরিদপুরগামী পিকআপের (যশোর-ন-১১-১৩৩৯) সংঘর্ষ হয় সকাল ৮টার দিকে। খবর পেয়ে জেলা পুলিশ ও ট্রাফিক পুলিশ হতাহতদের উদ্ধার করে। বাসযাত্রী কাউকে ঘটনাস্থলে পাওয়া যায়নি। কানাইপুরের করিমপুর হাইওয়ে থানার ওসি সালাউদ্দিন চৌধুরী বলেন, দুর্ঘটনার দুই ঘণ্টা পর মহাসড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।

ঈদের সময় বাসে অতিরিক্ত ভাড়া এবং যান সংকটে নিম্ন আয়ের মানুষ পণ্যবাহী যানে যাত্রী হন। তবে নিহতদের স্বজন জানিয়েছেন, পিকআপে যাত্রী হওয়া সবাই ত্রাণের টাকা ও টিনের জন্য ফরিদপুর যাচ্ছিলেন। যদিও জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন, ত্রাণ দেওয়ার তথ্য তাঁর জানা নেই।

খবর পেয়ে জেলা প্রশাসক কামরুল আহসান তালুকদার ও পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।

যে কারণে দুর্ঘটনা
পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম বলেন, বাস ও পিকআপ অতিরিক্ত গতিতে চলছিল। পিকআপচালক তাঁর নির্দিষ্ট লেন ছেড়ে বিপরীত লেনে চলে যাওয়ায় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

বাসের ফিটনেস, বাস ও পিকআপচালকের লাইসেন্স ছিল কিনা, জানা যায়নি। ফরিদপুর ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন ম্যানেজার সুবাস বাড়ৈ বলেন, বাসটির গতি বেশি ছিল। এ কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

দুর্ঘটনাস্থলের পাশেই শেখ লিমনের বাড়ি। তিনি জানান, মহাসড়কের এ অংশে গর্ত রয়েছে। ঈদের আগে ২২-২৩টি ছোট দুর্ঘটনা ঘটেছে। মঙ্গলবার ওই গর্তগুলোর কাছেই দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনার পর বাসচালক ও সহকারী পালিয়ে যান। ফরিদপুর ট্রাফিকের পরিদর্শক তুহিন লস্কর বলেন, বাসে তল্লাশি করে গাড়ি কিংবা চালকের কোনো কাগজপত্র পাওয়া যায়নি। যত দ্রুত সম্ভব এগুলো সংগ্রহ করে তদন্ত কমিটিকে দেওয়া হবে।

কী বলছে সওজ
সওজ ফরিদপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ ইমরান ফারহান বলেন, ফরিদপুর থেকে যশোর পর্যন্ত এ মহাসড়কের কানাইপুর অংশ অতীতে দুর্ঘটনাপ্রবণ ছিল। দুই বছর আগে সড়কের দুই কিলোমিটারে বাঁক সরলীকরণ করা হয়েছে। সড়কের প্রশস্ত এবং জিওমেট্রিক্যাল ডিজাইন রয়েছে। রোড কন্ডিশন ফেয়ার। তাহলে কেন দুর্ঘটনা– প্রশ্নে তিনি বলেন, দুটি গাড়ির নিয়ন্ত্রণহীন গতি এবং মহাসড়কে চলাচলের নিয়ম অমান্য করায় দুর্ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।

জেলা প্রশাসনের ভাষ্য ও অনুদান
জেলা প্রশাসক কামরুল আহসান তালুকদার বলেন, নিহতদের দাফনে সরকার ২০ হাজার টাকা করে তাৎক্ষণিক অনুদান দিয়েছে। চিকিৎসাধীনরা পেয়েছেন ১০ হাজার টাকা। এ ছাড়া নিহতের পরিবারকে ৫ লাখ এবং আহতদের পরিবারকে ৩ লাখ টাকা করে দেওয়া হবে।

স্থানীয় কানাইপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন ও সাবেক চেয়ারম্যান ফকির বেলায়েত হোসেন বলেছেন, কানাইপুর একটি বৃহৎ ব্যবসা কেন্দ্র ও ব্যস্ততম শিল্প এলাকা। এখানে মহাসড়ক আরও প্রশস্ত এবং বিভাজক থাকা দরকার।

আট জেলায় নিহত আরও ১১
ফরিদপুরের নগরকান্দায় গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের বড় কুমারদিয়া এলাকায় ট্রাকের ধাক্কায় মোটরসাইকেল আরোহী সুমাইয়া আক্তার (৩৫) ও তাঁর আট মাস বয়সী ছেলে মোহাম্মদ মীরের মৃত্যু হয়েছে। সুমাইয়ার স্বামী আজমিন ও মেয়ে ফাতেমা আক্তার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

চট্টগ্রামের পতেঙ্গার আউটার লিঙ্ক রোডের চরপাড়া এলাকায় সোমবার রাতে পাজেরো গাড়ির চাকা ফেটে লাওসের নাগরিক ফুটফাফোন বুমবাম জেইডলা (২৩) নিহত হয়েছেন। তিনি এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের শিক্ষার্থী ছিলেন।

ময়মনসিংহ-শেরপুর মহাসড়কে উপজেলার রামচন্দ্রপুরে গতকাল সকালে দুই বাসের সংঘর্ষে দু’জন নিহত ও অন্তত ৩৫ জন আহত হন। নিহতরা হলেন বাসের হেলপার শহীদুল ইসলাম (২৬) ও যাত্রী চৈতি আক্তার (২০)।

ঈদের ছুটি শেষে কর্মস্থলে ফেরার পথে গতকাল ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে মির্জাপুরের চরপাড়া বাইপাস এলাকায় দুর্ঘটনায় গার্মেন্টকর্মী রুবি বেগম (৩৬) নিহত হয়েছেন। গাইবান্ধার পলাশবাড়ী থেকে আজমেরী পরিবহনের বাসটি সড়ক বিভাজকে ধাক্কা খেয়ে দুমড়েমুচড়ে যায়।

গোপালগঞ্জ-কোটালীপাড়া সড়কে উপজেলার মাঝবাড়ি এলাকায় গতকাল সকালে বাসের ধাক্কায় আলিম বিশ্বাস (৬২) নিহত হয়েছেন। পিরোজপুরের ইন্দুরকানীর টগড়ার ওয়াপদা বাজার এলাকায় গতকাল দুপুরে রিকশার ধাক্কায় আরিফার (৩) মৃত্যু হয়।

বগুড়ার শেরপুরে উপজেলা পরিষদের সামনে ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কে সোমবার রাতে ট্রাকচাপায় আবদুল কুদ্দুস (৭০) নিহত হয়েছেন। ফেনীর ছাগলনাইয়ার পানুয়াঘাট রাস্তার মাথায় গাড়িচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী নোমান (১৫) মারা গেছে। নাটোরের বড়াইগ্রামে গাছের সঙ্গে মোটরসাইকেলের ধাক্কায় নিহত হয়েছে দশম শ্রেণির ছাত্র আকিব হাসান (১৪)।
[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যুরো ও প্রতিনিধিরা]

 

আরও পড়ুন

×