ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

চোখে কালো কাপড় বেঁধে সড়কে স্কুলশিক্ষার্থী

চোখে কালো কাপড় বেঁধে সড়কে স্কুলশিক্ষার্থী

চোখে কালো কাপড় বেঁধে স্কুল শিক্ষার্থীর অবস্থান কর্মসূচি। ছবি:সমকাল

নওগাঁ সংবাদদাতা

প্রকাশ: ২২ এপ্রিল ২০২৪ | ০৫:৩১ | আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০২৪ | ০৬:০১

পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে ফাতেমা আফরিন ছোঁয়া। বাসার টেলিভিশনে অন্যান্য অনুষ্ঠানের পাশাপাশি খবরও দেখে এই শিশু শিক্ষার্থী। মাঝেমধ্যে সামনে এসে পড়ে অনেক সড়ক দুর্ঘটনার সংবাদ। কানে আসে হতাহতের স্বজনের আহাজারি ও আর্তনাদের ভাষা। এতে মন কাঁদে ছোট্ট মেয়েটিরও। কয়েকদিন আগে রাস্তায় তার বাবার এক বন্ধুর মৃত্যুর খবরও দেখেছে সে। এমনই সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা তার মনে অনেক দাগ কাটে। বিবেকের তাড়নায় অন্যদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে। কেউ তাকে তেমন গুরুত্ব না দেওয়ায় একাই গড়ে তোলে আন্দোলন। কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে গতকাল রোববার নেমে যায় সড়কে। আকুতি জানায়, বাঁচার মতো বাঁচার।

গতকালও প্রায় সারাদেশে তীব্র তাপপ্রবাহ বিরাজ করছিল। কোথাও কোথাও মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রাও রেকর্ড করা হয়। এই কাঠফাটা রোদে সকাল সাড়ে ১০টায় নওগাঁ শহরের তাজের মোড় ও ব্রিজের মোড় সড়কে দেখা যায় ফাতেমাকে। কালো কাপড়ে দুই চোখ আড়াল করে হাতে একটি প্ল্যাকার্ড নিয়ে হাঁটছিল, আর দু’পাশ দিয়ে চলাচল করছিল বিভিন্ন যানবাহন। তার প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল– ‘সড়কে নিরাপত্তা চাই, বাঁচার মতো বাঁচতে চাই, দুর্ঘটনা এড়াতে ট্রাফিক আইন প্রয়োগ চাই।’ তার এই একক আন্দোলন দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছেন অন্য পথচারীসহ স্থানীয়রা। তারা মেয়েটিকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং তার দাবির সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করেছেন।

শহরের চকবাড়িয়া এলাকার পথচারী সাহেব আলী বলেন, ‘আমরা আসলে সড়কে কেউ নিরাপদ নই। বাসা থেকে বের হলে সুস্থভাবে নিরাপদে ফিরতে পারব কিনা– তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এ অবস্থায় ছোট্ট শিশুর এমন উদ্যোগ সত্যিই আমাদের মুগ্ধ করেছে। সবাই সোচ্চার হলে সড়ক নিরাপদ হবেই।’

আয়েশা সিদ্দিকা, দেওয়ান সুরভী আক্তার নিভা, নাসরিন আক্তার নামে আরও তিন পথচারী বলেন, তীব্র রোদ ও গরম উপেক্ষা করে মেয়েটির এই প্রতিবাদ অন্যদের অনুপ্রাণিত করেছে। তার দাবি সমর্থন করছেন সবাই। তাকে দেখে অনেক কিছুই শেখার আছে। প্রতিদিনই সড়কে তাজা প্রাণ ঝরে যাচ্ছে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে সবারই এক হয়ে আন্দোলন করতে হবে।

 

একাই সড়কে নিরাপত্তা চেয়ে রাস্তায় নামার কারণ জানতে চাইলে শিশু ফাতেমা জানায়, টিভি-পত্রিকায় প্রতিদিন সে অনেক মৃত্যুর খবর দেখে। প্রাণহানিগুলোর অধিকাংশই সড়ক দুর্ঘটনাজনিত। রাস্তায় বের হলে বা স্কুলে যাওয়ার পথে আবার বাড়িতে মা-বাবার কাছে নিরাপদে ফেরার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এই বিষয়গুলো তাকে খুব কষ্ট দেয়, ভীত করে।

ফাতেমা বলে, ‘বেশ কয়েকদিন আগে নওগাঁ শহরের ইয়াদ আলীর মোড়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান এক বাবা ও মা। আর বেঁচে যায় তাদের পাঁচ বছরের শিশু সন্তান। সেই শিশুটির এখন কী করুণ দশা। শিশুটি তো চিরদিনের জন্য বাবা-মায়ের আদর-ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আমি চাই সড়ক নিরাপদ হোক, কারও প্রাণহানি না ঘটুক। আমরা নিশ্চিন্তে রাস্তায় চলাফেরা করতে চাই। এটি নিশ্চিত করতে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সরকারের কাছে আকুল আবেদন জানাই।’

ফাতেমার বাবা সংগীতশিল্পী খাদেমুল ইসলাম ক্যাপ্টেন বলেন, ‘গত ১৮ এপ্রিল সুনামগঞ্জের ছাতকের সুরমা ব্রিজ এলাকায় জনপ্রিয় গানের গীতিকার, সুরকার, শিল্পী মতিউর রহমান হাসান ওরফে পাগল হাসান মারা যান সড়ক দুর্ঘটনায়। নিহত হাসান আমার সহকর্মী ও বন্ধু ছিলেন। এটিসহ বেশ কয়েকটি ঘটনা আমার মেয়ের মনে মারাত্মকভাবে দাগ কেটেছে। সে প্রতিদিন এত মৃত্যুর খবর শুনে নিজেকে স্থির রাখতে পারছিল না। এক পর্যায়ে সে সড়কে নিরাপত্তা চেয়ে রাস্তায় দাঁড়াতে চায়। মেয়ের এই মহৎ ও যৌক্তিক চাওয়াকে না বলতে পারিনি।’

নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) নওগাঁ জেলা শাখার সভাপতি এ এস এম রায়হান আলম বলেন, নিরাপদ সড়কের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চলছে। পাশাপাশি যানবাহন চালক ও মালিকদেরও সচেতন করা হচ্ছে। এর পরও দুর্ঘটনা ঘটছে, মানুষ মারা যাচ্ছে। এই অসহায়ত্ব দেখে ফাতেমার উদ্যোগ সবাইকে মুগ্ধ করেছে। তার মতো সবাই সচেতন হলে এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ করলে প্রাণহানি অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব।

নওগাঁর পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রাশিদুল হক বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে এই জেলায় পুলিশের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রাস্তায় শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ট্রাফিকের পাশাপাশি পুলিশ সদস্যরাও নিরবচ্ছিন্ন সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। ফলে অন্যান্য জেলার তুলনায় নওগাঁয় দুর্ঘটনা কম।
 

আরও পড়ুন

×