ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

হাওরে আনন্দ আছে শঙ্কাও

বোরোর বাম্পার ফলন

হাওরে আনন্দ আছে শঙ্কাও

বোরো ধান কাটার উৎসব চলছে হাওরে। সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরের নলুয়ার ভুরাখালী থেকে সোমবার তোলা সমকাল

পঙ্কজ দে, সুনামগঞ্জ

প্রকাশ: ২৩ এপ্রিল ২০২৪ | ০১:৫৩

বাতাসে পাকা ধানের ম ম গন্ধ। মাঠের পর মাঠ সোনালি শীষ দুলছে। ধানের বাম্পার ফলনে তাই হাসি ফুটেছে কৃষকের মুখে। প্রচণ্ড খরতাপে সারাদেশের মানুষ কষ্ট পেলেও, তারা খুব খুশি। কারণ এতে দ্রুত পাকবে ধান। তবে বাম্পার ফলনের মধ্যেও আছে পাকা ধান ঘরে ওঠানো নিয়ে শঙ্কা। বেশির ভাগ এলাকায় ধান কাটার শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। ধান কাটার ভরা মৌসুমে কম্বাইন হারভেস্টার কেলেঙ্কারি নিয়ে জেলাজুড়ে রয়েছে আলোচনা।

সুনামগঞ্জের অন্যতম বৃহত্তম হাওর ‘দেখার হাওর’। সদর, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, দোয়ারাবাজার ও ছাতক– চার উপজেলায় বিস্তৃত এ হাওর। গতকাল সোমবার বোরোভান্ডার বলে খ্যাত এ হাওর ঘুরে দেখা গেছে, কেউ শ্রমিক দিয়ে ধান কাটাচ্ছেন, কেউ কম্বাইন হারভেস্টার দিয়ে। আবার কোনো কোনো কৃষক পরিবার-স্বজন নিয়ে নেমে গেছেন ধান কাটতে। বৃষ্টি না থাকায় দ্রুত ধান ঘরে তুলতে ব্যস্ত সবাই।

জেলায় এবার বোরো চাষাবাদ হয়েছে ২ লাখ ২৩ হাজার ৪০৭ হেক্টর জমিতে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধান ১৩ লাখ ৭০ হাজার ২০২  টন। চাল ৯ লাখ ১৩ হাজার ৪৬৮ টন। টাকার অঙ্কে ৪ হাজার ১১০ কোটি টাকার চাল উৎপাদন হবে এই জেলায়।

সোমবার পর্যন্ত কৃষি অফিসের হিসাব অনুযায়ী, ধান পেকেছে উঁচু এবং নিচু এলাকা মিলে ৪৬ দশমিক ৮ শতাংশ। ধান কাটা হয়েছে গড়ে ৩৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ। এর মধ্যে উঁচু হাওরে ৩৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ এবং নিচু হাওরে ৪৯ দশমিক ৮ শতাংশ।
হাওরের কৃষকরা বলেছেন, গত ২০-২৫ বছরের মধ্যে এরকম ভালো ফলন হয়নি। ২০১৭ সালের পর অকাল বন্যায় বড় রকমের দুর্যোগ বা ফসলহানির ঘটনা না ঘটলেও অতিবৃষ্টি, খরা ও শিলাবৃষ্টিতে লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হয়েছে। এবারের বাম্পার ফলনে হাওরজুড়ে বইছে আনন্দ ধারা।

দিরাই উপজেলার রাজাপুরের কৃষক আব্দুস সাত্তার জানালেন, এবার বেশির ভাগ জমি চুক্তিতে চাষাবাদ করতে দিয়েছেন তিনি। রোববার বর্গাচাষিরা ১৬ কেয়ার জমি মাড়াই করে এসে জানিয়ে গেছে, চুক্তির এক ছটাক ধানও কম দেবে না।
শাল্লা উপজেলার শাল্লা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান কৃষক ছত্তার মিয়া বলেন, নিজে ৯০ কেয়ার (তিন কেয়ারে এক একর) ধান করেছি, এর মধ্যে ১৫ কেয়ার জমির ধান কেটেছি, দু-একদিনের মধ্যে আরও ২০-৩০ কেয়ার কাটা পড়বে। জানালেন, প্রতি কেয়ারে ২০-২২ মণ ধান পেয়েছেন। কেউ কেউ কেয়ারপ্রতি আরও বেশি পেয়েছেন বলে দাবি তাঁর।

যেসব ধানে ফলন ভালো হয়েছে বিনা ২৫, হীরা, ব্রি-২৯, জনকরাজ ও সুগন্ধা ধানের বীজে ফলন ভালো হয়েছে জানিয়ে শাল্লার ভান্ডাবিল হাওর পাড়ের কৃষক অরুণ দাস বলেন, ‘সময়মতো বৃষ্টি অইছে (হয়েছে), যত্ন ঠিকমতো করা অইছে, ইতার লাগি (এ জন্য) ধান ইবার (এবার) ভালা অইছে।’

শাল্লার ছায়ার হাওরের পশ্চিম পাড়ের উজান গাঁওয়ের কৃষক চন্দন কর্মকার বলেন, ছায়ার হাওরের পশ্চিম পাড়ের এক কৃষক বিনা-২৫ চাষ করেছেন। তাঁর জমিতে প্রতি কেয়ারে ২২ মণ ধান হয়েছে।

আনন্দের মধ্যেও আছে শঙ্কা
তবে ধান ওঠানো নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে কৃষকের মনে। বেশির ভাগ এলাকায় ধান কাটার শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। ভরা মৌসুমে ধান কাটার যন্ত্র কম্বাইন হারভেস্টার না পেয়ে হন্যে হয়ে ঘুরছেন কৃষক। সরকারের কাছ থেকে ৭০ ভাগ টাকা ভর্তুকি নিয়ে কেনা জেলার ৮৭৩টি কম্বাইন হারভেস্টারের বড় একট অংশ গোপনে বিক্রি হয়েছে অন্য জেলায়। এসব ধান কাটার যন্ত্র নিজ এলাকায় নেই। কিন্তু কৃষি অফিসের তালিকায় এখনও এই যন্ত্রকে এলাকায় দেখানো হচ্ছে। কৃষকদের অভিযোগ, কম্বাইন হারভেস্টার কেনাবেচায় কৃষি অফিসের দুর্নীতিবাজ কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশ থাকায় তালিকায় এখনও হারভেস্টার এলাকায় দেখানো হচ্ছে।
শাল্লার হবিবপুর ইউনিয়নের আনন্দপুর গ্রামের স্থানীয় ইউপি সদস্য বাবলু রায় ও তাঁর সহোদর পৃতেশ রায়ের নামে দুই বছর আগে ভর্তুকির কম্বাইন হারভেস্টার বরাদ্দ হয়। ইউপি সদস্য দুই বছর আগেই তাঁর বরাদ্দের হারভেস্টার বিক্রি করে দিয়েছেন অন্য জেলায়। কিন্তু এখনও শাল্লার হারভেস্টারের তালিকায় তাঁর নাম ২৫ নম্বরে। বাবলু রায় নিজেই এই প্রতিবেককে বলেছেন, দেড় লাখ টাকা লাভে তিনি এ যন্ত্র বিক্রি করে দিয়েছেন।

জমি থেকেই ধান বিক্রি
সরকার ধানের মণ ১ হাজার ২৮০ টাকা নির্ধারণ করলেও ধান কাটা-মাড়াইয়ের খরচ মেটাতে ৮০০ টাকা মণ দরে হাওরের বিভিন্ন উপজেলায় বিক্রি হচ্ছে ধান। স্থানীয় কৃষকরা জানান, সরকার ৭ মে থেকে ক্রয়কেন্দ্রগুলোতে ধান কেনা শুরুর ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু এর মধ্যেই নানা প্রয়োজনে কম দামে জমি থেকেই ধান বিক্রি করছেন কৃষক।

শাল্লা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ছত্তার মিয়া বলেন, আগেভাগে সরকার ধান কেনা শুরু করলে বাজারে ধানের দাম আরও বেড়ে যেত। এখন কাঁচা ধান ৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, বোরো ধান উঁচু জমিতে ৩৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ এবং হাওরে ৪৯ দশমিক ৮ শতাংশ কাটা শেষ হয়েছে। মঙ্গলবার গড়ে আরও ৮ শতাংশ কাটা শেষ হবে। এক সপ্তাহের মধ্যে ৯০ ভাগ ধান কাটা শেষ হবে।

আরও পড়ুন

×