ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

আশ্রয়ণের পুরোনো ৮০ ঘর সাত লাখে বিক্রি

আশ্রয়ণের পুরোনো ৮০ ঘর সাত লাখে বিক্রি

আশ্রয়ণের ঘর ভেঙে নেওয়ার কাজে ব্যস্ত কয়েকজন শ্রমিক। মঙ্গলবার মাদারীপুর সদরের খোয়াজপুরে

মাদারীপুর প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০২ মে ২০২৪ | ২১:৩১

দরপত্র ছাড়াই মাদারীপুরের একটি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৮০টি পুরোনো ঘর বিক্রির অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এতে সরাসরি জড়িত উপজেলার খোয়াজপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জয়নাল মোল্লা। তিনি সাত লাখ টাকায় ঘরগুলো মাদারীপুর শহরের ভাঙাড়ি ব্যবসায়ী হারুন আকনের কাছে বিক্রি করেছেন।

তবে চেয়ারম্যান দাবি করেন, ইউএনওর নির্দেশনায় জায়গা খালি করতে সহায়তা করেছেন। টাকা লেনদেনে জড়িত নন তিনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউএনও মো. আল মামুন দায়সারা বক্তব্য দেন। বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ওবাইদুর রহমান কালু খান।

গুচ্ছগ্রাম তৈরির লক্ষ্যে খোয়াজপুর আশ্রয়ণ প্রকল্পে ২০০৫ সালে ৮০টি ঘর তৈরি করা হয়। প্রকল্পের কাজ সরাসরি তত্ত্বাবধান করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। লোহার অ্যাঙ্গেলের কাঠামোর ওপর টিনের ছাউনি ও বেড়া দিয়ে তৈরি করা হয় ঘরগুলো। চারপাশের ভিত্তি পাকা থাকলেও মেঝে ছিল মাটির। দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় ওই ঘরগুলো বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। তাই সেখানে নতুন করে ঘর নির্মাণের উদ্যোগ নেয় জেলা প্রশাসন।

মঙ্গলবার ওই আশ্রয়ণের ঘর ভেঙে নেওয়ার সংবাদ পেয়ে সরেজমিন গিয়ে নিবাসীদের কাউকে পাওয়া যায়নি। খোয়াজপুরের বাসিন্দা মনোয়ার হোসেন বলেন, ঘরগুলোর কয়েকজন বাসিন্দা তাঁকে জানিয়েছেন, নতুন করে ঘর নির্মাণের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। তাই তাদের কিছুদিনের জন্য সেখান থেকে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সপ্তাহখানেক আগে সব বাসিন্দা অন্য জায়গায় চলে গেছেন।

পরে এসব ঘর দরপত্র বা সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ছাড়াই চেয়ারম্যান জয়নাল মোল্লার নেতৃত্বে বিক্রি করে দেওয়া হয়। ঘরগুলো কিনে নেন মাদারীপুর শহরের ভাঙাড়ি ব্যবসায়ী হারুন আকন। সোমবার তিনি ঘরগুলো ভাঙা শুরু করেন, বুধবার শেষ হয়। তিনি ট্রাকে করে মালপত্র নিয়ে গেছেন। 

হারুন আকনের ভাষ্য, সাত লাখ টাকায় তিনি ঘরগুলো কিনেছেন। এ জন্য কোনো বিজ্ঞপ্তি বা নিলাম হয়নি। ইউনিয়ন পরিষদে সরাসরি চেয়ারম্যান জয়নাল মোল্লার সঙ্গে বসেই ঘরগুলো কিনেছেন। তাঁকে (চেয়ারম্যান) নগদ টাকা বুঝিয়ে দেওয়ার পরই ঘর ভাঙায় হাত দিয়েছেন। বিজ্ঞপ্তি বা নিলামের বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। সেটি চেয়ারম্যানের বিষয়।

এসব বিষয়ে কিছুই জানতেন না এলাকাবাসীও। ঘর ভেঙে নেওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবি-ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে আলোড়ন তৈরি হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ইউএনও মো. আল মামুনের নির্দেশে বিক্রির টাকার অংশ আশ্রয়ণের নিবাসীদের হাতে তুলে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন চেয়ারম্যান। তবে এতে সন্তুষ্ট নন ওই এলাকার বাসিন্দারা। তারা সঠিক তদন্তের মাধ্যমে বিষয়টির সুরাহা দাবি করেছেন।

প্রকল্পটি নির্মাণের সময় খোয়াজপুরের ইউপি চেয়ারম্যান ছিলেন মোহাম্মদ আলী মুন্সী। তাঁর ভাষ্য, সেনাবাহিনী নির্মিত ঘরগুলোর ভিত্তি মজবুত। নিলামে বিক্রি হলেও ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা দাম উঠত। কোনোমতেই সাত লাখ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা নয়। বর্তমান চেয়ারম্যান জয়নাল মোল্লা গোপনে কত টাকা নিয়েছেন, কে জানে!

সাবেক এই জনপ্রতিনিধির ভাষ্য, বড় কথা হলো, সরকারি ঘর তিনি (জয়নাল) ব্যক্তিগতভাবে বিক্রি করতে পারেন না। এর তদন্ত ও সঠিক বিচার হওয়া দরকার। জানাজানি হওয়ার পর উপকারভোগীদের টাকা বুঝিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন চেয়ারম্যান।

এ বিষয়ে চেয়ারম্যান জয়নাল মোল্লা বলেন, ‘ঘরগুলো বসবাসের অনুপযোগী ছিল। তাই ইউএনও ঘরগুলো অপসারণ করতে বলেছেন। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) ও ইউএনও জানেন। আমি কারও কাছে ঘর বিক্রি করিনি।’

ভাঙাড়ি ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টাকা নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বিষয়টি এড়িয়ে যান। তিনি বলেন, ‘সব উপজেলা অফিস জানে। আমার দায়িত্ব ঘরগুলো অপসারণ করা। এর তদারক করেছি মাত্র।’

পিআইও মশিউর রহমানের ভাষ্য, সেখানে নতুন ঘর নির্মিত হবে। তাই জায়গা খালি করে দিতে বলা হয়েছিল। অন্য কিছু তাঁর জানা নেই।

সদরের ইউএনও মো. আল মামুন বলেন, পরিত্যক্ত ঘরগুলো উপকারভোগীদের নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, তারাই নেবেন। বিক্রি করার প্রক্রিয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি মোবাইল ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।

এতগুলো ঘর বিক্রির বিষয়ে কিছুই জানতে না উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ওবাইদুর রহমান কালু খান। তাঁর ভাষ্য, এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকারি সম্পদ নিয়ে ছিনিমিনি খেললে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক মো. মারুফুর রশীদ খান বলেন, সরকারি ঘর বিক্রির কোনো সুযোগ নেই। কেউ বিক্রি করে থাকলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আরও পড়ুন

×