বালুখেকোর স্বঘোষিত মহাল তিস্তা ও ঘাঘট
প্রতিদিন উত্তোলন এক লাখ ঘনফুট বালু

ফাইল ছবি
স্বপন চৌধুরী, রংপুর
প্রকাশ: ১৯ মে ২০২৪ | ০০:৩১ | আপডেট: ১৯ মে ২০২৪ | ০৮:৩৬
বালুমহাল আইনে আছে, বিপণনের উদ্দেশ্যে কোনো উন্মুক্ত স্থান, চা বাগানের ছড়া বা নদীর তলদেশ থেকে বালু বা মাটি উত্তোলন করা যাবে না। এ ছাড়া সেতু, কালভার্ট, ড্যাম, ব্যারাজ, বাঁধ, সড়ক-মহাসড়ক, বন, রেললাইন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা বা আবাসিক এলাকা থেকে বালু ও মাটি উত্তোলন নিষিদ্ধ। কিন্তু তা না মেনে রংপুরে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছেন। বিশেষ করে ঘাঘট ও তিস্তা নদী থেকে বছরের পর বছর অবৈধভাবে বালু উত্তোলন চলছে। এগুলো যেন তাদের স্বঘোষিত বালুমহাল।
প্রতিদিন অবৈধভাবে প্রায় ১ লাখ ঘনফুট বালু উত্তোলন করা হচ্ছে তিস্তা ও ঘাঘট থেকে। স্থানীয় বাজারে যার মূল্য প্রায় ১০ লাখ টাকা। আর সেই বালু জেলার বিভিন্ন স্থানে স্থাপনা নির্মাণ ও খাল ভরাটের কাজে ব্যবহার হচ্ছে। অবৈধ এই বাণিজ্য অব্যাহত থাকায় সরকার বঞ্চিত হচ্ছে বিপুল রাজস্ব থেকে, অন্যদিকে হুমকিতে রয়েছে পার্শ্ববর্তী ফসলি জমি। স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে অবৈধ কারবার অবাধে চলছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।
সংশ্লিষ্ট থানা এলাকার কিছু পুলিশ সদস্য, তহশিল অফিস, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালীদের সিন্ডিকেটের তৎপরতায় তৈরি হয়েছে এসব বালুমহাল। সাধারণত ভ্রাম্যমাণ আদালত হয় দিনে। অন্যদিকে রাতে বালু উত্তোলন বেশি হয়। এ ছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালত নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছানোর আগেই খবর দিয়ে লোকজনকে সরিয়ে দেওয়া হয়। বিভিন্ন সময় ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান পরিচালনা করে জেল-জরিমানা করলেও দু-এক দিন কর্মযজ্ঞ বন্ধ রেখে ফের উত্তোলন শুরু করে চক্রটি।
রংপুরের নদীবেষ্টিত বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে এই কারবারের চিত্র। বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে শ্যালো মেশিন দিয়ে এবং শুকনো চরে কোদাল ও বেলচা দিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। তিস্তা নদী এলাকার পয়েন্টগুলো হলো– গঙ্গাচড়ার মহিপুরে তিস্তা সেতুর নিচে, গান্নারপাড়, ধামুর বোল্লারপাড়, দক্ষিণ কোলকোন্দ সিংগীমারী, দক্ষিণ কোলকোন্দ গ্রোইন বাঁধ, দক্ষিণ কোলকোন্দ বাবুপাড়া, পাইকান ব্যাঙপাড়া, পাইকান পীরপাড়া, উত্তর চিলাখাল, গাওছোয়া, পূর্ব ইচলী ও মধ্য ইচলী। ঘাঘটের পয়েন্টগুলো হলো– পাইকান ডাক্তারপাড়া, পাইকান চওড়াপাড়া, পাইকান দোলাপাড়া, পাইকান বগুলাগাড়ী, দক্ষিণ পানাপুকুর ফকিরপাড়াসংলগ্ন বাগানবাড়ি, বেতগাড়ী মুন্সিপাড়া ও বেতগাড়ী বালাপাড়া। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি স্থানে মৎস্য প্রকল্পের নামে খাল খনন করে মাটি ও বালু বিক্রি করা হচ্ছে। এসব স্থান থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রভাব খাটিয়ে, কেউ প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে কিংবা কৌশলে ম্যানেজ করে বছরের পর বছর বালুর কারবার চালিয়ে যাচ্ছেন। রংপুর সদরের দমদমা, হারাগাছের মায়াবাজার ও মর্নেয়া চরসহ পীরগাছা, মিঠাপুকুর ও বদরগঞ্জের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। স্থানীয় লোকজন ও সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে জানা যায়, প্রতিবছর গঙ্গাচড়া থেকে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি ঘনফুট বালু ও ভিটি বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এর ৫৫ শতাংশ তিস্তা থেকে, ৩০ শতাংশ ঘাঘট থেকে এবং অবশিষ্ট ১৫ শতাংশ বিভিন্ন স্থানের মৎস্য প্রকল্পের খনন করা খাল থেকে উত্তোলন করা হচ্ছে।
সম্প্রতি রাতে রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার বড়বালা এলাকায় ঘাঘট নদী থেকে অবৈধ বালু উত্তোলনের দায়ে চালকসহ একটি ট্রাক জব্দ করে পুলিশ। গঙ্গাচড়ায়ও দফায় দফায় ট্রাকসহ বোমা মেশিন জব্দ করা হলেও বন্ধ হচ্ছে না বালু উত্তোলন। উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) নয়ন কুমার সাহা বলেন, বালু কারবারিদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের অভিযান অব্যাহত আছে। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোবাশ্বর হাসান বলেন, রংপুরে শুধু একটি বৈধ বালুমহাল রয়েছে, যা জেলা প্রশাসন থেকে ইজারা দেওয়া হয়েছে। বাকি সব অবৈধ। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে জেলা প্রশাসন। অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান অব্যাহত আছে। বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালনা করে অনেক পয়েন্ট থেকে বালু এবং বালু উত্তোলনের সরঞ্জাম আটকসহ জেল-জরিমানা করা হচ্ছে। অবৈধ বালু উত্তোলনে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
- বিষয় :
- বালুখেকো