‘মোর অ্যাহোন দরকার ঘর, মাথা গোঁজার ঠাঁইর’

রিমালে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৃহস্পতিবার পটুয়াখালীর কলাপাড়ার মোজাহার উদ্দিন বিশ্বাস কলেজ মাঠে ফোকাস বাংলা
কলাপাড়া ও কুয়াকাটা (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৪ | ০০:৪৮ | আপডেট: ৩১ মে ২০২৪ | ০৭:২০
‘মোর অ্যাহোন দরকার একডা ঘর, মাথা গোঁজার ঠাঁইর। নইলে বউ-মাইয়্যা-পোলা লইয়্যা কই থাকমু আর ক্যামনে থাকমু। বুইন্যায় মোর ঘরডা ভাইঙা হালাইছে এবং ছোট্ট একডা দোকানঘর আছিল, হেইডাও উড়াইয়্যা লইয়্যা গ্যাছে। তাই বাঁইচ্চা থাহার মতন একটু সম্বল দরকার অ্যাহোন।’ গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে এ আক্ষেপের কথাগুলো বলছিলেন পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে ত্রাণ নিতে আসা সত্তরোর্ধ্ব আবুল হোসেন তালুকদার।
কলাপাড়া উপজেলার চাকামইয়া ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বেতমোড় গ্রামে তাঁর বাড়ি। স্ত্রী, এক ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে তাঁর সংসার। তিন সন্তানই দিনমজুরের কাজ করেন এবং তা দিয়েই চলছে তাদের জীবন-জীবিকা। এক সময় আবুল হোসেন তালুকদারের ‘তালুকদারি’ থাকলেও কালের স্রোতে সব হারিয়ে এখন আছে শুধু ছোট্ট একটি দোকান ও একটি ঘর। গত সোম ও মঙ্গলবার দু’দিনের ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে তাঁর সেই বসতঘর ও দোকানটিও বিধ্বস্ত। এখন পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন এই বৃদ্ধ।
গতকাল প্রধানমন্ত্রী হেলিকপ্টার থেকে ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত পটুয়াখালীর মঠবাড়িয়া ও পাথরঘাটা এলাকায় ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র পরিদর্শন করেন। পরে কলাপাড়ায় দুর্গত মানুষের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করেন। ঘূর্ণিঝড়ের পাঁচ দিনের মাথায় প্রধানমন্ত্রীকে কাছে পেয়ে মনোবল ফিরে পান উপকূলবাসী। রিমালে ঘরবাড়ি ভেঙে গেলেও তাঁকে এক নজর দেখার জন্য ও ত্রাণ পেতে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন অনেকে।
প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে ত্রাণ নেওয়ার জন্য সকাল ১০টার আগেই কলাপাড়া সরকারি মোজাহার উদ্দিন বিশ্বাস ডিগ্রি কলেজ মাঠে চলে আসেন আবুল হোসেন। তিনি ত্রাণগ্রহীতার কার্ড পেয়ে গলায় কার্ডটি ঝুলিয়ে রাখেন। প্রখর রোদের মধ্যে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে মাঠের এক কোণে বসে পড়েন। লোকমুখে এক বস্তা করে চাল দেওয়ার কথা শুনে হতাশ হয়ে এই বৃদ্ধ ত্রাণ না নিয়েই বাড়ির পানে ছুটতে থাকেন।
আবুল হোসেন বলেন, ‘মোর একডা ঘর দরকার। কিন্তু হেইডা না দিয়া যদি মোরে এক বস্তা চাউল দেয়, হেইয়্যা দিয়া ১০ দিন খাইতে পারমু। হের পর কী হরমু? অ্যাহোন যে বাড়িত যামু হেই টেকাডাও মোর কাছে নাই। মুই একডা ঘর চাই, মাথা গোঁজার ঠাঁই চাই।’
এদিকে, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার কাছে অনেক প্রত্যাশা নিয়ে দীর্ঘ ২৫ কিলোমিটার দূর থেকে এসেছিলেন কলাপাড়া উপজেলার লতাচাপলি ইউনিয়নের তুলাতলী গ্রামের দেলোয়ার হোসেন আকন (৫২)। কিন্তু কিছু না পেয়ে খালি হাতে বাড়ি ফিরে যান। তিনি বলেন, ‘বুইন্যায় মোর ঘরডা গ্যাছে। অ্যাহোন মাথা গোঁজার ঠাঁইও নাই। আইছিলাম প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা হোনতে। ছোটকাল থেইক্যা আওয়ামী লীগ করি। মনে করছিলাম একডা ঘর পামু, তাও জুটল না কপালে।’
চাকামইয়া এলাকার মোসা. নাসিমা বেগম (৬০) বলেন, ‘মুই ত্রাণের কার্ড পাইছিলাম। কিন্তু রাস্তা বন্ধ থাকায় নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন প্রধানমন্ত্রীর ধারে মোরে যাইতে দেয় নাই। তাই বাড়ি চইল্যা যাইতাছি।’ কুয়াকাটার আজিমপুর গ্রামের আব্দুল মালেক ফরাজী (৬৫) বলেন, ‘বুইন্যায় মোর ঘরের চাল উড়াইয়্যা লইয়্যা গেছে। অ্যাহোনও ঘরডা ঠিক করতে পারি নাই। কেউ ত্রাণও দেয় নাই এবং জনপ্রতিনিধিরা কেউ খোঁজখবরও নেয় নাই মোগো। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শুনতে আইছিলাম।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী গতকাল পাঁচজনের হাতে ত্রাণ দিয়ে এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। তাতে জনপ্রতি ১৪ কেজি চালসহ ডাল, লবণ, চিনি, সয়াবিন তেল, মরিচ, হলুদ ও ধনিয়ার গুঁড়ার খাদ্যসামগ্রী দেওয়া হয়। আজ থেকে পর্যায়ক্রমে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত দুই হাজার মানুষকে এ ত্রাণ দেওয়া হবে।
প্রধানমন্ত্রীকে দেখতে না পেয়ে ফিরে গেছেন হাজারো মানুষ
প্রধানমন্ত্রীকে এক নজর দেখতে না পেয়ে ফিরে গেছেন হাজারো মানুষ। শেখ হাসিনাকে এক নজর দেখতে ২৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে কলাপাড়ায় আসেন উপজেলার ধুলাসার ইউনিয়নের কাউয়ার গ্রামের আনিস তালুকদার (৭২)। কিন্তু বেলা ১১টার পর জনসভাস্থলের দিকে যেতে না দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রীকে চোখের দেখা দেখতে না পেয়ে হতাশা প্রকাশ করেন তিনি। বৃদ্ধ আনিস বলেন, ‘৭০ সাল থেকে শেখ সাহেবের নৌকায় ভোট দিয়ে আসছি। তাই শেখের মাইয়ারে এক নজর দেখতে ও তাঁর মুখের কথা শুনতে ছুটে আসছিলাম।’
তুলাতলী গ্রামের দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ে তাঁর ঘর ভেঙে গেলেও শেখ হাসিনাকে দেখতে পেলে মনে শান্তি লাগত, তাও পেলাম না।’ তাদের মতো অবস্থা আরও অনেকেরই।
- বিষয় :
- ঘূর্ণিঝড় রিমাল
- প্রধানমন্ত্রী