ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

‘মোরা ত্রাণ চাই না, চাই শক্ত বেড়িবাঁধ’

‘মোরা ত্রাণ চাই না, চাই শক্ত বেড়িবাঁধ’

ইন্দুরকানীতে ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে বিলীন কচা নদীর পাশের টগড়া গ্রামের বেড়িবাঁধ সমকাল

ইন্দুরকানী (পিরোজপুর) প্রতিনিধি 

প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৪ | ২২:৪৯

‘এমন বইন্যার পানি মোগো জনমে দেহি নাই, এত পানি হইছে– বইন্যার পানি গাঙ দিয়া ডুইকা মোর ঘরডা ভাসাইয়া নিয়া গেছে। এহন মুই বউ-পোলাপান লইয়া কই থাকমু। মোরা ত্রাণ চাই না, চাই শক্ত বেড়িবাঁধ।’ বলছিলেন পিরোজপুরের ইন্দুরকানী উপজেলার কচা নদীর তীরবর্তী টগড়া গ্রামের দিনমজুর আ. গণি শেখ। ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে সৃষ্ট প্রবল জলোচ্ছ্বাসে বেড়িবাঁধ ভেঙে গণি শেখের বসতঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। 
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড়ে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে ইন্দুরকানীতে কচা নদীর তীরবর্তী পাউবোর ১০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বিলীন হয়েছে। বিলীন হওয়া বেড়িবাঁধ ও নদী তীরবর্তী ২৫টি স্লুইসগেটের বাঁধ পানির চাপে ভেঙে যাওয়ায় ৪৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ফলে অধিকাংশ  কাঁচা  ঘরের মেঝে পানিতে ধসে যায়। বসতঘরে পানি ওঠায় হাজার হাজার বাসিন্দা চরম দুর্ভোগে রয়েছেন। গত রোববার রাত থেকে মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত পানি লোকালয় থেকে না সরায় স্থানীয় বাসিন্দাদের বসতঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ কলা ক্ষেত, মৎস্য ঘের, ধান ও সবজি ক্ষেতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। উপদ্রুত অধিকাংশ এলাকায় ছয় দিন ধরে বিদ্যুৎ নেই। খাবার ও রান্নার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন প্রাণীর মৃতদেহ ও গাছের পাতা পচে নদী, খাল ও পুকুরের পানি বিনষ্ট হয়েছে। 
জলোচ্ছ্বাসে কলারণ এলাকার বেড়িবাঁধ ভেঙে ‌আটটি ইটভাটায় পানি ঢুকে কাঁচা ইট ও কয়লার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কচা নদীর তীরবর্তী খোলপটুয়া গ্রামের একটি ইটভাটা মালিক আল-মামুন বলেন, রিমালের প্রবল জলোচ্ছ্বাসে কচা নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ায় তাঁর ইটভাটায় সাত লোখ কাঁচা (পোড়ানো হয়নি) ইট শেষ হয়ে গেছে। এ ছাড়া কয়েক লাখ টাকার কয়লা পানিতে ভেসে গেছে। এতে তাঁর কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। তিনি 
জানান, নদী তীরবর্তী সাতটি ভাটার কাঁচা ইট ও কয়লা বিনষ্ট হওয়ায় মালিকদের প্রায় সাত কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। 
বৃহস্পতিবার কচা নদী তীরবর্তী টগড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ঘূর্ণিঝড় রিমালে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে প্রায় তিন কিলোমিটার বেড়িবাঁধ একেবারে বিলীন হয়ে গেছে। এ ছাড়া ইন্দুরকানী, কালাইয়া, সাঈদখালী, বালিপাড়া, চরবলেশ্বর, চণ্ডিপুর, খোলপটুয়া ও কলারণের বেড়িবাঁধ ভেঙে ব্যাপক ক্ষতি সাধন হয়েছে। গাছ পড়ে ও পানির তোড়ে দুই হাজারের বেশি কাঁচা ও আধাপাকা ঘরের ক্ষতি হয়েছে। শত শত কাঁচা ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে।  

আলাপকালে গ্রামের বাসিন্দা দিনমজুর গনি মিয়া বলেন, ‘বন্যার পানিতে বান ভাইঙা পানি ডুইক্যা ঘরডা শেষ হয়ে গেছে। এহন কই থাকমু?’ 
একই গ্রামের মজিবুর রহমান বলেন, বন্যায় বেড়িবাঁধ ভেঙে গ্রামের অধকাংশ ঘর ডুবে যাওয়ায় কাঁচা ঘরের ক্ষতি হয়েছে। নতুন করে বাঁধ না দিলে পরিবার-পরিজন নিয়ে বাস করা যাবে না। সরকারের কাছে  ত্রাণ সহায়তা নয়, টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি জানান তিনি। 
কালাইয়া গ্রামের দুলাল বৈদ্যর ভাষ্য, কচা নদীর তীরবর্তী যেটুকু বাঁধ ভালো ছিল, ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রবল জলোচ্ছ্বাসে তা বিলীন হয়ে গেছে। স্লুইসগেটগুলোর বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় পানির তোড়ে বাড়িঘরসহ ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
কচা নদীর তীরবর্তী চণ্ডিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মশিউর রহমান মঞ্জু বলেন, ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে জলোচ্ছ্বাসে বেড়িবাঁধ ভেঙে তাঁর এলাকায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। জনসাধারণকে রক্ষায় সরকারের কাছে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি জানান তিনি। 
মৎস্য ও কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলার তিন শতাধিক মৎস্য ঘের ও পাঁচ শতাধিক পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। ঝড়ে অসংখ্য কলাগাছ ভেঙে যাওয়ায় কলা চাষিরাও বিপুল ক্ষতির মুখে পড়েছেন। 

উপজেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ঘূর্ণিঝড় রিমালে এলাকার বেড়িবাঁধ ভেঙে ঘরবাড়ি, গাছপালা ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের তথ্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। 
ইন্দুরকানী উপজেলা চেয়ারম্যান জিয়াউল আহসান গাজী বলেন, ঝড়ের তাণ্ডব ও জলোচ্ছ্বাসে ঘরবাড়ি ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, যার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। তাঁর ধারণা, সব মিলিয়ে এ উপজেলায় ১০০ কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছে। তিনি জানান, সাধ্যমতো ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে থেকে তাদের সার্বক্ষণিক সহায়তা করছেন। খাদ্য সহায়তার পাশাপাশি নগদ অর্থ দিয়ে ঘর নির্মাণে সহায়তা করছেন।
পিরোজপুর পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী নুসাইব হোসেন বলেন, ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে জলোচ্ছ্বাসের আঘাতে কচা নদীর নির্মাণাধীন বেড়িবাঁধসহ পুরোনো বাঁধেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। নুতন করে প্রাক্কলন করে দ্রুত বাঁধ নির্মাণকাজ শুরু করা হবে। 

আরও পড়ুন

×