ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

গৃহহীন ২০ হাজার পরিবার, দিশেহারা ২৮ হাজার চাষি

গৃহহীন ২০ হাজার পরিবার, দিশেহারা ২৮ হাজার চাষি

ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামত হয়নি ৬ দিনেও। জোয়ার হলেই পানি ঢুকছে কয়রা উপজেলার দশহালিয়া গ্রামে। শুক্রবার তোলা সমকাল

 মামুন রেজা, খুলনা ও শেখ হারুন অর রশিদ, কয়রা

প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৪ | ২৩:১৪ | আপডেট: ০১ জুন ২০২৪ | ১০:২৯

‘প্রথম কিস্তির চিংড়ি ধরার আগে শুরু হোয়ছিল দাবদাহ। তখন অল্প কিছু চিংড়ি ধরতি পারিছিলাম। মনে করিছিলাম, আষাঢ়ের বৃষ্টি শুরু হলি দ্বিতীয় কিস্তিতে অনেক চিংড়ি ধরতি পারবো। কিন্তু তার আগেই ঝড়ে সব লন্ডভন্ড হইয়ে গেল। দুর্যোগে এবারও বাঁধ ভাইঙে আমাগে সব আশার গুড়ে বালি ঢেলে দিল’– কথাগুলো কয়রা উপজেলার দশহালিয়া গ্রামে মৎস্যচাষি আলমগীর হোসেনের। গত ২৬ মে রাতে ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় তাঁর গ্রাম। এতে ভেসে যায় তাঁর ৩০ বিঘার চিংড়ি ঘের। 

একই গ্রামের দিনমজুর মনিরুল ইসলামের ঘর ভাঙে প্রবল বাতাসে। তিনি বলেন, ‘আমার নতুন করে ঘর বানানোর সামর্থ্য নেই। বাধ্য হয়ে স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে মামাবাড়িতে গিয়ে থাকতি হচ্ছে।’

নয়ানি গ্রামে এখনও তলিয়ে আছে সুকুমার মণ্ডলের পাঁচ বিঘা জমির আউশ ধানের বীজতলা, ঝিঙা ও ঢ্যাঁড়সের ক্ষেত। তিনি বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় রিমাল আমারে সর্বস্বান্ত করে দিছে। এখন কী করব বুঝে উঠতি পারতিছিনে।’

শুধু এই তিনজন নন, ঘূর্ণিঝড় রিমালে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে খুলনার কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছা উপজেলায় অর্ধলক্ষাধিক পরিবার। তাদের মধ্যে ঘরবাড়ি পুরোপুরি ভেঙে যাওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে প্রায় ২০ হাজার পরিবার। পুকুরের মাছ ও ঘেরের চিংড়ি ভেসে গেছে অন্তত ১৪ হাজার মৎস্যচাষির। ফসলের ক্ষেত তলিয়েছে আরও ১৪ হাজার কৃষকের। তবে ঝড়ের প্রায় এক সপ্তাহ পার হলেও সরকারি-বেসরকারিভাবে তেমন কোনো সহযোগিতা মেলেনি। 

জেলা প্রশাসন থেকে জানা যায়, ঘূর্ণিঝড়ে ২০ হাজার ৭৬২টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ও ৫৬ হাজার ১৪২টি আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে। জেলা মৎস্য অফিস জানিয়েছে, ৩৫৫ হেক্টর পুকুর, ১০ হাজার ২২৪ হেক্টর চিংড়ি ঘের, ১ হাজার ৫৯০ হেক্টর কাঁকড়া ও কুঁচিয়া খামার প্লাবিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অন্তত ১৪ হাজার ৭১ মৎস্যচাষি। শুধু মৎস্য খাতেই ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২৪৬ কোটি টাকা। 

কৃষি সম্প্রসারণ অফিস জানায়, ঘূর্ণিঝড়ে ১ হাজার ৬৮ হেক্টর জমির আউশ ধানের বীজতলা, আউশ, পাট, সবজি, ভুট্টা, তিল, মুগডাল, আখ, পান, তরমুজসহ বিভিন্ন ক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অন্তত ১৩ হাজার ৭৯৬ কৃষক। আর্থিক হিসাবে ক্ষতির পরিমাণ ৪২ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। 

কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছা উপজেলা ঘুরে দেখা যায়, গৃহহীনদের কেউ কেউ আশ্রয় নিয়েছেন প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে, কেউ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মসজিদের বারান্দায়। কেউ কেউ কোনোমতে বেড়িবাঁধের ওপর ঝুপড়ি ঘর তুলে মাথা গুঁজেছেন। 

বেড়িবাঁধ মেরামত না করায় দাকোপ উপজেলার কামিনিবাসিয়াসহ আশপাশের পাঁচ-ছয় গ্রাম বৃহস্পতিবারও জোয়ারের সময় প্লাবিত হয়। এ ছাড়া কয়রা দশহালিয়াসহ বিভিন্ন গ্রাম গত পাঁচদিন ধরে জোয়ারের পানিতে ডুবছে।

বিভিন্ন গ্রামে গবাদি পশু নিয়েও বিপাকে পড়েছেন মালিকরা। দেখা দিয়েছে গবাদি পশুর খাদ্য সংকট। 

কয়রা উপজেলা মেরিন ফিশারিজ কর্মকর্তা পবিত্র কুমার ঘোষ বলেন, ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে মৎস্য খাতেই সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। মৌসুমের মাঝামাঝিতে এমন ধাক্কায় ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্যচাষিদের ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা কম। 

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আব্দুল করিম জানান, ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য এ পর্যন্ত ২৬৮ টন চাল, সাড়ে ২৩ লাখ টাকা, শিশুখাদ্য বাবদ সাড়ে ৬ লাখ টাকা ও গবাদি পশুর খাদ্য বাবদ ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। ঘর নির্মাণসহ পুনর্বাসনের জন্য এখনও কোনো অর্থ বরাদ্দ আসেনি।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয়দেব পাল জানান, মৎস্যচাষিদের সহযোগিতার জন্য এখনও কোনো বরাদ্দ আসেনি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খুলনার উপপরিচালক কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, তারা ক্ষয়ক্ষতির তালিকা তৈরি করে প্রধান কার্যালয়ে পাঠিয়েছেন।

আরও পড়ুন

×