ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

ঘূর্ণিঝড় রিমাল

সম্বলহারারা ঋণের ভারে ন্যুব্জ

ভেসে গেছে চিংড়ি ঘের চাষিদের হাহাকার

সম্বলহারারা ঋণের ভারে ন্যুব্জ

ফাইল ছবি

 জাহিদুর রহমান, মোংলা (বাগেরহাট) থেকে

প্রকাশ: ০১ জুন ২০২৪ | ০১:১৯ | আপডেট: ০১ জুন ২০২৪ | ০১:১৯

কেউ হারিয়েছে ঘর। তলিয়ে গেছে কারও জাল, ভেসে গেছে নৌকা। যে সমুদ্র ঘিরে লেপ্টে জীবন, তারই উথালপাতাল থাবায় লন্ডভন্ড জীবিকা। সাগরে হারিয়ে যাওয়া সাম্পানের মতোই উপকূলের জেলে জীবনে নেমে এসেছে অমানিশা। ঘূর্ণিঝড় রিমালের ক্ষত তাদের পাশাপাশি উপকূলের কৃষকদের ফেলতে যাচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি দাদনের জাঁতাকলে।

বাগেরহাটের মোংলার সুন্দরবন ও পশুর নদঘেঁষা চিলা ইউনিয়নের কেয়াবুনিয়া গ্রামের জেলে মজিবুর রহমানের জলেই কাটে জীবন। সেখানেই নিত্য জীবিকার যুদ্ধ। জাল-জলই মজিবুরের পুরো পৃথিবী। রিমালের কারণে গভীর সমুদ্রে এক সপ্তাহ বন্ধ রয়েছে মাছ ধরা। ডাঙায় বাঁধা নৌকা। জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেছে জাল। ৫০ হাজার টাকা সুদে ঋণ নিয়ে এবার মাছ ধরতে নেমেছিলেন মজিবুর। সব হারিয়ে ঋণ পরিশোধের চিন্তায় এখন দিশেহারা তিনি।

রিমাল উপকূলীয় মোংলার সুন্দরবনের আশপাশের গ্রামের পরতে পরতে রেখে গেছে ভয়াল চিহ্ন; বাড়িতে বাড়িতে ধ্বংসযজ্ঞ। ঋণ চুকিয়ে ক্ষতির খতিয়ান কতটা দীর্ঘ হবে, তা নিয়েই পেরেশান জেলে ও কৃষকরা। যেমনটি বলছিলেন সুন্দরবনে মাছ ধরতে গিয়ে ঘূর্ণিঝড়ে আটকে পড়া মোংলা পৌরসভার ডোবা বস্তির বাসিন্দা মানিক চন্দ্র দাশ। তিনি বলেন, সুন্দরবনে খালে মাছ ধরতে গিয়ে হঠাৎ ঝড় শুরু হওয়ায় ফিরতে পারিনি। ছোট খালেও ঢেউয়ের তোড়ে নৌকা ভেঙে যায় যায় অবস্থা। মুহূর্তে মনে উঁকি দিয়েছিল, বেঁচে ফেরা হবে না! হঠাৎ নৌকাটি ডুবে যায়, কোনো রকমে ভেসে ভেসে আরেক নৌকায় তীরে ফিরি।
মানিক তীরে ফিরেছেন ঠিকই। কিন্তু এসে দেখেন পানিতে ঘরের সব জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে গেছে। এক মহাজনের কাছ থেকে দাদনে ৩০ হাজার টাকা নিয়েছিলেন। এখন তাঁর ঘরে খাবার নেই, জীবিকার অবলম্বনও হয়েছে ধ্বংস। দাদন শোধের চিন্তায় মানিকের দু’চোখে ঘুম নেই। বলেন, ‘ভাত খাইতে পারছি না। মহাজন বলে, ট্যাকা দেও, ট্যাকা দেও।’

মোংলার সোনাইতলা ইউনিয়নের জয়খাঁ গ্রামের অধিকাংশের পেশা মৎস্যজীবী। রিমালে থমকে গেছে তাদের জীবন। ছোট্ট ট্রলারে সুন্দরবনের নদীতে মাছ ধরে সংসার চলে গ্রামটির বাসিন্দা পলাশ সরকারের। আয় কখনও ৫০০; কখনও ৭০০ টাকা। এনজিওর ঋণের কিস্তি সপ্তাহে ২০০ টাকা। ঘূর্ণিঝড় রিমালের সময় পলাশ বাড়িতেই ছিলেন। কিন্তু পানির তোড়ে ভেসে গেছে তাঁর নৌকা। এখন পরিবার-পরিজন নিয়ে খেয়ে না খেয়ে চলছেন।

মোংলার পশুর নদপারের বাসিন্দা আইয়ুব আলীর সংসার চলে গলদা চিংড়ির রেণু ধরে। প্রতি রেণুতে ১২ পয়সা, তাও বিক্রির পরে দেন মহাজন। বর্ষায় ইলিশের নৌকায় মাছ ধরতে যান গভীর নদী ও সাগরের মোহনায়। রিমাল তাঁর ঘরের সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছেন আইয়ুব। মাছ শিকার বন্ধ, রোজগার না থাকায় দিতে পারছেন না কিস্তি। রোজ কথা শোনাচ্ছেন এনজিওকর্মীরা। এর পরও আইয়ুব আলীর স্বগতোক্তি, ‘ঝড় আইলে আমাগো আল্লাহই চালায়। মাছ ধরতে না পারায় কামাই একেবারে বন্ধ। কামাই না থাকলে ঋণ করে খাই। কামাই করে ঋণ দেই। কেউ খোঁজ না নিলেও বছরের পর বছর এভাবেই চলে আমাদের সংসার।’

এমন পরিস্থিতিতে আজ শনিবার থেকে নদী-খালে মাছ এবং বনে প্রাণীদের বিচরণ ও প্রজনন কার্যক্রমের সুরক্ষায় ৩১ আগস্ট পর্যন্ত তিন মাসের জন্য বন্ধ হচ্ছে সুন্দরবনের দুয়ার। এ সময় পর্যটকও নিষিদ্ধ। এটিই এখন জেলেদের জন্য ‘গোদের ওপর বিষফোড়া’।

মোংলার সুন্দরবন ইউনিয়েনের জেলে ভবেশ দাস বলেন, সুন্দরবনে মাছ, কাঁকড়া ও মধু আহরণ করে চলে আমাদের সংসার। তিন মাস বন্ধ থাকবে পাস। এক সপ্তাহ আগে ঝড়ের সংকেত শুনে বন থেকে বাড়ি ফিরেছি। খুব বেশি মাছ ধরতে পারিনি। গত মঙ্গলবার ঝড় থেমে গেলেও ফরেস্ট স্টেশন থেকে বনে ঢোকার অনুমতি দিচ্ছে না। সামনের তিন মাস বন্ধের সময় সংসার চালানোর মতো সঞ্চয় নেই। কী করব, ভেবে পাচ্ছি না। শেষমেশ দাদনই ভরসা।

রিমালের আঘাতে বাগেরহাটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন মৎস্য চাষিরা। আম্পান, ইয়াস ও আইলায় ঘের ভেসে যাওয়ায় বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছিলেন তারা। এবারও পানিতে ভেসে গেছে মাছ। চিংড়ির ঘেরগুলোতে থই থই পানি, যেন প্রবহমান বিশাল নদী! পশুর নদপাড়ে চিলাবাজার এলাকায় সাকিনাথের একটি চিংড়ির ঘের আছে, যেটি চিলাবাজার থেকে একটু দূরে। তিনি জানালেন, ঘের পুরো তলিয়ে ভেসে গেছে মাছ। বছরের শুরুতে সাকিনাথ লাখ খানেক টাকা খরচ করে ঘের উপযোগী করেন নতুন করে চিংড়ি ছাড়ার। একরাশ হতাশা নিয়ে সাকিনাথ বলেন, ঘেরে ৫০ হাজার টাকার চিংড়ি রেণু ছেড়েছিলাম। এখন বেশ বড় হয়েছে, কিছু দিনের মধ্যে বিক্রি করতাম। কিন্তু জলোচ্ছ্বাসে সব ভেসে গেছে। রিমালে জীবিকার উৎস ধ্বংস হওয়ায় এখন ঋণের বোঝা সঙ্গী করে কেমন করে দিন পাড়ি দিতে হবে, শঙ্কাভরা সেই গল্পও শোনালেন সাকিনাথ। তাঁর ভাষায়, ঘের প্রস্তুতের ৮০ হাজার টাকার ঋণের বোঝা টানতে হচ্ছে। এখন আবার ঋণ করে ঘের প্রস্তুত করতে পারব কিনা, তা ভাবতেই ঘুমাতে পারছি না। আবারও দুর্যোগ হতে পারে। মাছ ছাড়ব; সেটিও যেতে পারে ভেসে। তখন হয়তো দাদন শোধে ছাড়তে হতে পারে জমি।

সাকিনাথের মতো মোংলার আরও কয়েক ঘের চাষির সঙ্গে কথা হয়। কমবেশি সবারই দুঃখ এক সুতোয় বোনা, ঘের থেকে মাছ তোলার পূর্ণ মৌসুমে তাদের জীবিকায় বড় আঘাত দিয়ে গেল রিমাল, যার জের টানতে হবে সারা বছর।

সুন্দরবনের খুলনা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক এ জেড এম হাছানুর রহমান বলেন, আগামী তিন মাস প্রান্তিক জেলে-বাওয়ালিদের খাদ্য সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করব। তাদের প্রতি পরিবারকে মাসে ৪০ কেজি চাল দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। বনজীবীদের একটি তালিকাও পাঠিয়েছি। পরিবেশ ও জলবায়ু মন্ত্রণালয় হয়ে তা অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে।

 

আরও পড়ুন

×