ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

ধার শোধে সম্ভ্রম খুইয়ে প্রাণও দিলেন বিষপানে

অভিযোগ নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরলেও কেউ পাত্তা দেয়নি

অভিযোগ নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরলেও  কেউ পাত্তা দেয়নি

প্রতীকী ছবি

 সুজন মোহন্ত, কুড়িগ্রাম

প্রকাশ: ০২ জুন ২০২৪ | ০০:৩৯

খালাতো ভাইবোন। সম্পর্কে জড়িয়ে বিয়ে করেন। পাঁচ বছরের সংসারে ফুটফুটে মেয়ে দুই বছর বয়সী। অভাবের তাড়নায় করা ধারের টাকা জাহাঙ্গীর আলম (২৭) ও আশা খাতুন (২৩) দম্পতির জীবন তছনছ করে দিয়েছে। পাওনাদারের ফাঁদে পড়ে প্রথমে সম্ভ্রম খুইয়ে সমাজের চোখে আশা খাতুন হয়েছেন কুলটা। পরে স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে বিচারের জন্য লড়েছেন। কিন্তু পুলিশ প্রশাসন থেকে জনপ্রতিনিধি– সবার কাছ থেকে বিমুখ হয়ে দু’জনে মিলে মুখে তুলে নেন বিষ। জাহাঙ্গীর সুস্থ হলেও গত বুধবার মারা গেছেন মাসের পর মাস ধর্ষণের শিকার গৃহবধূ আশা।

কুড়িগ্রামের চর রাজীবপুর উপজেলার সদর ইউনিয়নের কলেজপাড়া গ্রামের এ ঘটনায় গত শুক্রবার রাতে মামলা করেন মৃতের মামা আকবর আলী। তিনি জাহাঙ্গীরেরও আপন মামা। পরে পুলিশ সদর ইউনিয়নের মণ্ডলপাড়া গ্রামের মাংস ব্যবসায়ী জয়নাল মিয়া (৪৮) ও আলম হোসেনকে (৪০) গ্রেপ্তার করে। অন্য দুই আসামি কারিগরপাড়ার শুক্কুর আলী (৫০) ও টাঙালিয়াপাড়ার মো. সোলায়মান (২৯) পলাতক।

মৃতের স্বজন, পুলিশ ও প্রতিবেশীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে বসবাস দিনমজুর জাহাঙ্গীরের। অভাব মেটাতে কয়েক মাস আগে জাহাঙ্গীর টাঙ্গাইলে যান রাজমিস্ত্রির কাজে। দোকানে কাজ করার সুবাদে প্রতিবেশী মাংস ব্যবসায়ী জয়নালের কাছ থেকে ৪০ হাজার টাকা ধার নেন তিনি। ২০ হাজার টাকা শোধ করে টাঙ্গাইলে যান জাহাঙ্গীর। কিছুদিন পর বাকি টাকার জন্য জয়নাল চাপ দিতে থাকে আশাকে। এটিকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করে জয়নাল এক পর্যায়ে আশাকে ধর্ষণ করে এবং সহযোগী আলমকে দিয়ে তা মোবাইল ফোনে ধারণ করায়। এর পর ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়ানোর ভয় দেখিয়ে জয়নাল দুই মাস ধরে ধর্ষণ করে আসছে।

আলমের কাছ থেকে ভিডিও পায় তাদের সহযোগী শুক্কুর ও সোলায়মান। পৃথকভাবে চারজনই ভিডিওকে টোপ বানিয়ে আশার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করে। আশার বাবা কয়েক বছর আগে মারা গেছেন, মা দুবাই প্রবাসী। স্বামীর অনুপস্থিতিতে বাড়িতে চারজনের যাতায়াত সম্প্রতি ‘অনৈতিক সম্পর্ক’ হিসেবে জানাজানি হয়। এ-কান ও-কান ঘুরে জাহাঙ্গীরও শোনেন এবং বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে জেরার এক পর্যায়ে বিস্তারিত জানেন। পরে দু’জনের মধ্যে এ নিয়ে ঝগড়া হয়। এক পর্যায়ে তারা ধর্ষকদের বিচার দাবিতে গত ২২ মে স্থানীয় ইউপি সদস্য আনোয়ার হোসেনসহ কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তির কাছে যান। কিন্তু তারা বিচার না করে মীমাংসা করতে বলেন।

এর পর ২৩ মে জাহাঙ্গীর থানায় অভিযোগ দিতে গেলে কনস্টেবল রবিউল ইসলাম ও থানার গাড়িচালক মাজহারুল ইসলাম তাঁকে পাশের চা দোকানে নিয়ে মীমাংসার পথে হাঁটতে বলে অভিযোগ করতে দেননি। নিরুপায় হয়ে বাড়ি ফিরে পরদিন এ দম্পতি বিষপান করেন।

প্রতিবেশীরা চর রাজীবপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দু’জনকে ভর্তি করেন। অবস্থার অবনতি হলে আশাকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড ও কিছুটা সুস্থ হওয়ায় ছাড়পত্র দেওয়া হয় জাহাঙ্গীরকে। কিন্তু অসচ্ছলতার কারণে আশাকে হাসপাতালে না নিয়ে বাড়িতে আনা হয়। ২৯ মে দুপুরে আশার মৃত্যু হয়। ভিডিও ছড়ানোর ভয় দেখিয়ে চারজন কীভাবে দুই মাস ধরে ধর্ষণ করেছে, তা মৃত্যুর আগে বিশদ বলে গেছেন আশা। তাঁর বক্তব্যের প্রায় ২৩ মিনিট অডিও সমকালের হাতে এসেছে।

এদিকে বিষপানের খবর পেয়ে ইউপি সদস্য আনোয়ার, পুলিশ সদস্য রবিউল ও মাজহারুলের মাধ্যমে জয়নাল ২০ হাজার টাকা দিতে যায় ভুক্তভোগীদের। মোকদ্দমা এড়িয়ে মীমাংসার আশ্বাসে সে টাকা দিতে যায়। এতে মধ্যস্থতাকারী ছিলেন আশার মায়ের চাচাতো ভাই মো. আমেশ। আশার মৃত্যুর পরে সবাই গা-ঢাকা দিয়েছে। অন্যদিকে, ঘটনা ভিন্ন দিকে নিতে আশার স্বামীকে ইউপি সদস্য আনোয়ার ‘মানসিক ভারসাম্য’ সাজানোর চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। জানতে চাইলে আনোয়ার সমকালকে বলেন, ‘জয়নালরা এসে মীমাংসার জন্য জোরাজুরি করে। ধর্ষণের ঘটনা নাকি তাদের বিরুদ্ধে রটনা। পরে আমি থানা পুলিশ না করে সমাধানের চেষ্টা করেছি। কিন্তু এরই মধ্যে স্বামী-স্ত্রী ঝগড়া করে বিষপান করে একজন মারা গেছে। জাহাঙ্গীর পাগল। তার প্রতি স্ত্রীও বিরূপ ছিলেন শুনেছি।’
তবে আশা ও জাহাঙ্গীরের মামা আকবর আলী বলেন, ‘আমার ভাগনে পাগল নয়। তাকে কখনও এমন বিষয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে হয়নি। অভাব থাকলেও আমার ভাগনে-ভাগনির সুখের সংসার ছিল। কিন্তু অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তাদের সর্বনাশ করা হয়েছে। আমি এ ঘটনায় জড়িতদের বিচার চাই।’

ঘটনার বিষয়ে জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, টাঙ্গাইল থেকে বাড়ি ফিরে শারীরিক অবস্থা খারাপ দেখে জিজ্ঞাসার এক পর্যায়ে আশা তাঁর সঙ্গে করা জয়নালদের অনাচারের বিস্তারিত বলে। পরে আমরা মেম্বারসহ গণ্যমান্য ব্যক্তি ও থানায় ঘুরেছি। কিন্তু বিচার পাইনি। যেখানে গেছি, সবাই টাকা নিয়ে মীমাংসা করতে বলেছেন। আমি তাতে রাজি হইনি। সমাজে মুখ দেখাতে পারছি না, বিচার চেয়েও মিলছে না। নিরুপায় হয়েই দু’জন বিষপান করে দুনিয়া ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু আশা আমাকে একা রেখে চলে গেল– কান্না করতে থাকেন জাহাঙ্গীর।

চর রাজীবপুর থানার কনস্টেবল রবিউল ও গাড়িচালক মাজহারুলের সঙ্গে যোগাযোগ করে মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক থানার এক সদস্য জানিয়েছেন, চার মাংস ব্যবসায়ীর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা খেয়েছেন ইউপি মেম্বার আনোয়ার, আমেশ, কনস্টেবল রবিউল ও গাড়িচালক মাজহারুল। এজন্য অভিযুক্তদের শুরু থেকেই তারা বাঁচানোর চেষ্টা করেন।
থানার ওসি আশিকুর রহমান বলেন, আশা খাতুন ধর্ষণের শিকার হয়ে বিষপান করে হাসপাতালে ভর্তি হলেও কর্তৃপক্ষ আমাদের জানায়নি। তাঁর মৃত্যুর পর বিষয়টি জানাজানি হলে একটি অপমৃত্যু মামলা রেকর্ড করা হয়। এখন পর্যন্ত আশার স্বামী থানায় কোনো অভিযোগ করতে আসেননি। তিনি আরও বলেন, দুই পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে।

কুড়িগ্রামের পুলিশ সুপার আল আসাদ মো. মাহফুজুল ইসলাম বলেন, শুক্রবার রাতে মৃতের মামা মামলা করেন। অভিযান চালিয়ে হোতাসহ দু’জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি অন্যদের ধরতে অভিযান চলছে। এ ঘটনায় পুলিশের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

 

আরও পড়ুন

×