ইমোতে হ্যাকার চক্রের ফাঁদ

লোগো
সনি আজাদ, চারঘাট (রাজশাহী)
প্রকাশ: ১৬ জুলাই ২০২৪ | ২২:২৪
কিছুদিন আগে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার সৌদি প্রবাসী হামিদুর রহমানের ইমো অ্যাপ থেকে বাবা ওসমান গনির নম্বরে ফোন আসে। জানানো হয়, ছেলে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে। অপারেশনের জন্য ১ লাখ ২০ হাজার টাকা লাগবে। ওসমান গনি ধারদেনা করে ৯০ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেন। পরে ছেলের সঙ্গে কথা বলে তিনি জানতে পারেন তাঁর ইমো অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয়েছে।
সদর থানায় মামলা করেন হামিদুর রহমান। গত শুক্রবার রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার মেরামতপুর এলাকা থেকে শিমুল ইসলাম শুভ নামে এক হ্যাকারকে আটক করা হয়। শুভর শ্বশুরবাড়ি বাঘা উপজেলার মনিগ্রাম এলাকায়। পরে মামলার বাদীর সঙ্গে সমঝোতা করে মুক্তি পায় সে। ছাড়া পেয়ে ফের প্রতারণা শুরু করে।
প্রতারণার শিকার বাহরাইনের প্রবাসী ব্যবসায়ী আজিজুল ইসলামের পরিবারের কাছ থেকে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি। বুঝতে পেরে আজিজুল ইসলামের স্ত্রী ঢাকার কাফরুল থানায় মামলা করেন। গত মাসে ওই মামলায় বাঘা উপজেলার মনিগ্রাম এলাকা থেকে রাকিব ইসলাম নামে এক যুবককে আটক করা হয়। সেও সমঝোতা করে মুক্তি পায়।
দুবাই প্রবাসী রুহুল আমিনের ইমো হ্যাক করে স্ত্রী রাবেয়া আক্তারের কাছে ফোন করা হয়। বলা হয়, রুহুল আমিন পুলিশের হাতে আটক হয়েছে। তাকে ছাড়াতে দেড় লাখ টাকা লাগবে। স্ত্রী ধার করে সেই টাকা পাঠান। প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরে থানায় মামলা করেন রাবেয়া আক্তার। তদন্ত শেষে চুয়াডাঙ্গা ডিবি পুলিশ চারঘাটের নন্দনগাছী এলাকা থেকে তিন যুবককে আটক করে।
শুধু হামিদুর, আজিজুল কিংবা রুহুল আমিন নন, শত শত প্রবাসী প্রতারকদের হাতে তুলে দিচ্ছেন কষ্টার্জিত টাকা। তাদের ধরতে পুলিশ এবং র্যাব দুই বছরে চারঘাট উপজেলায় শতাধিক অভিযান পরিচালনা করেছে। আটক হয়েছে ৮৭ জন। মামলা হয়েছে ২৬টি। গত বছর চার দিনের ব্যবধানে ১৫ জন ইমো হ্যাকারকে আটক করে ডিজিটাল আইনে মামলা দিয়ে জেলহাজতে পাঠায় বাঘা থানা পুলিশ। খেড়ুর মোড় এলাকায় অভিযান চালিয়ে ছয়জনকে আটক করে র্যাব। এ সময় তাদের কাছে থেকে ১৩টি মোবাইল ফোন, ১৮টি সিমকার্ড ও ৩০ হাজার ৭১৫ টাকা উদ্ধার করা হয়।
জানা গেছে, ২০১৮ সালে নাটোরের লালপুরে ইমো প্রতারণার সূত্রপাত। হ্যাকারদের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় এলাকাটি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ধারাবাহিক অভিযান শুরু করলে এরা পালিয়ে পার্শ্ববর্তী বাঘা ও চারঘাট উপজেলায় নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে। চারঘাটের মেরামতপুর এলাকার শিমুল ইসলাম শুভ, নন্দনগাছী এলাকার শাহীন আলী ও খেড়ুর মোড় এলাকার সাদিকুর রহমান এবং বাঘার আড়পাড়ার রাজা পলাশ, তেপুকুরিয়ার রাকিবুল ইসলাম, ভানুকরের আনোয়ার হোসেন ও ছাতারী এলাকার রাজা আলী অবৈধ এ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে। প্রায় ৩০০ সদস্যের এই চক্রের আওতায় আরও তিন শতাধিক নারী ও পুরুষ জড়িত। ভিন্ন স্তরে ভাগ হয়ে কাজ করে তারা। প্রতিটি দলে ৮-১০ জন করে সদস্য আছে। প্রথম দল শিকার খোঁজে। দ্বিতীয় দল অ্যাপ হ্যাক করে। পরের দলটি কথা বলে টাকা আদায়ের ব্যবস্থা করে। শেষ দলটির কাজ বিকাশ কিংবা নগদের মাধ্যমে টাকা উত্তোলন।
চারঘাটের নাগরিক কমিটির সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, মাদক কারবারে বিনিয়োগ হয় এ টাকা। সীমান্তবর্তী উপজেলা হওয়ায় প্রতারকরা সহজেই পার্শ্ববর্তী দেশের নেটওয়ার্কও ব্যবহার করতে পারছে। গ্রামের সহজ-সরল মানুষ প্রতারণার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে।
চারঘাট মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সিদ্দিকুর রহমান বলেন, চারঘাট থেকে দেশের বিভিন্ন জেলার মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে হ্যাকাররা। প্রতারিতরা অন্য এলাকায় হওয়া আসামি গ্রেপ্তারের পর সংশ্লিষ্ট থানায় সোপর্দ করা হয়।
বাঘা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আমিনুল ইসলাম বলেন, বিভিন্ন জেলা থেকে প্রতারণার অভিযোগ আসছে। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন জেলায় লাখ লাখ টাকা প্রতারণার মামলা হচ্ছে।
চারঘাট-বাঘা সার্কেলের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার প্রণব কুমার বলেন, অভিযোগ দায়ের বা মামলার পর প্রতারিতরা টাকার বিনিময়ে হ্যাকারদের সঙ্গে সমঝোতা করে মামলা তুলে নিচ্ছে। তাতে হ্যাকাররা গ্রেপ্তার হলেও শাস্তির মুখোমুখি হচ্ছে না। ফিরে এসে আবারও প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছে।
- বিষয় :
- ইমো