ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

চলছে দখল-পাল্টা দখলের খেলা

খুলনার পরিবহন খাত

চলছে দখল-পাল্টা দখলের খেলা

.

 হাসান হিমালয়, খুলনা

প্রকাশ: ১৩ আগস্ট ২০২৪ | ০০:৪৩ | আপডেট: ১৩ আগস্ট ২০২৪ | ১৫:৪৬

ক্ষমতার পালাবদলের পর দখল ও পাল্টা দখলে অস্থিরতা বিরাজ করছে খুলনার পরিবহন সেক্টরে। নগরীর সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিনালে অবস্থিত মালিকদের চারটি সমিতির দুটিতে নেতৃত্বের পরিবর্তন হয়েছে। মোটর শ্রমিক ইউনিয়নে দুই দফা তালা মারার পর ফের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন বর্তমান কমিটির নেতারা।

এদিকে আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে থাকা দুটি মালিক সমিতিতে নতুন নেতৃত্ব আসার পর চাঁদাবাজি তিন ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে। আগে সড়কে বাস নামালে প্রতিদিন ৪২০ থেকে ৫২০ টাকা টাকা দিতে হতো। এখন কর্মচারীদের বেতন বাবদ ১২০ টাকা দিতে হচ্ছে। সড়কের মোড়ে মোড়ে চাঁদাবাজিও বন্ধ হয়েছে। এতে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে মালিক ও শ্রমিকদের মাঝে।

তবে জাতীয় পার্টির সাবেক নেতা আবদুল গফফার বিশ্বাসের নিয়ন্ত্রণে থাকা দুটি পরিবহন মালিক সমিতির চাঁদাবাজি আগের মতোই চলছে। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পরও তাদের প্রভাব-চাঁদা আদায় সামান্যও কমেনি। 

সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিনালে মালিকদের মোট চারটি সমিতি রয়েছে। এসব সমিতির আওতায় প্রতিদিন প্রায় ৪৫০ থেকে ৫০০টি বাস সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যায়। সড়কে বাস নামালেই প্রতিদিন মালিক সমিতিকে দিতে হয় ৩৫০ থেকে ৫২০ টাকা। এ ছাড়া বিভিন্ন পয়েন্টে পৃথক চাঁদা রয়েছে। বিপুল অঙ্কের এই টাকার ভাগবাটোয়ারাকে কেন্দ্র করেই সমিতি দখল-পাল্টা দখলের ঘটনা ঘটে।
২০০৮ সালের নির্বাচনের পর খুলনা বিভাগীয় বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির কক্ষ দখল নিয়ে নতুন নামে সমিতি চালু হয়। এর নাম দেওয়া হয় খুলনা জেলা বাস-মিনিবাস কোচ মালিক সমিতি। সংগঠনের সভাপতি হন মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান মিজান ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মহানগর যুবলীগের সাবেক আহ্বায়ক আনিসুর রহমান পপলু এবং কার্যকরী সভাপতি ছিলেন সোনাডাঙ্গা থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আবুল কালাম আজাদ কামাল।

২০১৮ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর চাচাতো ভাই ও যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ সোহেলের নির্দেশে সমিতিতে ওই তিন নেতার প্রবেশ বন্ধ হয়ে যায়। সমিতির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় যুগ্ম সম্পাদক ও মহানগর শ্রমিক লীগের সহসভাপতি আনোয়ার হোসেন সোনার কাছে। সেই থেকে সোনা একাই মালিক সমিতি পরিচালনা করতেন। 

গত ৫ আগস্ট সমিতির কক্ষ পাল্টা দখল নেন আগের নেতারা। তারা খুলনা বিভাগীয় বাস-মিনিবাস মালিক সমিতি নাম দিয়ে এখন কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। এই সমিতির সভাপতি মোকাম্মেল হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক রবিউল করিম। তারা সরাসরি বিএনপি বা অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কোনো পদে না থাকলেও বিএনপি সমর্থিত হিসেবে পরিচিত।

সোমবার বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায়, স্বাভাবিকভাবেই কার্যক্রম চলছে। তবে যাত্রী তুলনামূলক কম। সমিতির সাধারণ সম্পাদক রবিউল করিম বলেন, ১৫ বছর আগে প্রকৃত মালিকদের বের করে দিয়ে সমিতি দখল করে নেওয়া হয়। এখন শুধু আমরা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ও কাউন্টার ভাড়া বাবদ ১২০ টাকা করে আদায় করছি। তবে আনোয়ার হোসেন সোনা বলেন, তারা জোর করে তালা ভেঙে সমিতির অফিস দখল করেছে। 

এ ছাড়া রূপসা-বাগেরহাট বাস-মিনিবাস কোচ ও মাইক্রোবাস মালিক সমিতিও দখল হয়েছে। গত ৬ ও ৭ আগস্ট দুই দফায় সমিতির কক্ষে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। এখন তা দখল নেওয়ার চেষ্টা করছেন স্থানীয় বিএনপি নেতারা। এই সমিতির আওতাধীন খুলনা-বরিশালসহ দক্ষিণের বিভিন্ন রুটে প্রতিদিন গাড়ি নামালে চাঁদা দিতে হতো ৩৫০ থেকে ৫২০ টাকা। পটপরিবর্তনের পর সেটি এক লাফে কমে ১০০ থেকে ১২০ টাকায় নেমে এসেছে।

গত রোববার রূপসা বাস টার্মিনালে পরিবহন চালক সোলায়মান জানান, সমিতির টাকার সঙ্গে মোড়ে মোড়ে চাঁদাও কমেছে। 

দুই সমিতিতে বিশ্বাস পরিবারের কর্তৃত্ব বহাল
খুলনার পরিবহন খাতের অন্য বড় দুটি সংগঠন হচ্ছে খুলনা মোটর বাস মালিক সমিতি এবং আন্তঃজেলা বাস মিনিবাস মালিক সমিতি। খুলনা-কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, কালনা, বরিশাল, ঢাকা, পঞ্চগড়সহ দূরপাল্লার রুটে এই সমিতির পরিবহনগুলো চলাচল করে।

দুটি সংগঠনের সভাপতি সাবেক জাতীয় পার্টি নেতা আবদুল গফফার বিশ্বাস। মোটর বাসের সাধারণ সম্পাদক মোল্লা মুজিবর রহমান এবং আন্তঃজেলার সাধারণ সম্পাদক আফজাল হোসেন। তারা দু’জনই গফফার বিশ্বাসের অনুসারী। বিগত তিন দশকে সমিতি দুটির নেতৃত্বে রয়েছেন তিনি। একাধিকবার সরকার পরিবর্তন হলেও এই সমিতি দুটির কমিটি পরিবর্তন হয়নি। সমিতি দুটি প্রতি গাড়ি থেকে দৈনিক ৩৫০-৪২০ টাকা করে আদায় করে। 

গত দু’দিন সমিতি কার্যালয়ে গিয়ে আবদুল গফফার বিশ্বাসকে পাওয়া যায়নি। তিনি ফোনও ধরেননি। মালিক সমিতির সহসভাপতি ও তাঁর ছেলে শিবলী বিশ্বাস বলেন, অন্য সমিতির সঙ্গে আমাদের মেলানো যাবে না। আমাদের ১৮ জন কলারম্যান, ১২ জন স্ট্যাটার, ৪৫টির বেশি কাউন্টার রয়েছে। সমিতির কর্মচারী, ঝাড়ুদারসহ আরও অনেক কর্মচারী রয়েছেন। তাদের নিয়মিত বেতন দিতে হয়। এসব খাতে অনেক টাকা ব্যয় হয়। তবুও আমরা আজকালের মধ্যে টাকা কমানোর সিদ্ধান্ত নেব।

শ্রমিক ইউনিয়নে দু’বার তালা
খুলনার পরিবহন সেক্টরে শ্রমিকদের সবচেয়ে বড় সংগঠন খুলনা মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন। সরকার পতনের পর সংগঠনটির নেতারা পালিয়ে যান। গত ৫ থেকে ৭ আগস্ট পর্যন্ত দু’দফা তালা মেরে দখল নেওয়ার চেষ্টা হয়েছে ইউনিয়নটি। মালিক ও শ্রমিক ইউনিয়ন দখল-পাল্টা দখলে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে পুরো পরিবহন সেক্টরে। পরে টার্মিনালের স্থিতিশীলতার জন্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের রুমে তালা খুলে নির্বাচিতদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন।

মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন বিপ্লব বলেন, নির্বাচনের ফলাফল ও কাগজপত্র যাচাই করে ছাত্ররা দেখেছেন, আমরা ভোটে নির্বাচিত হয়েছি। পরে তারাই আমাকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে গেছেন।

আরও পড়ুন

×