ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

চলনবিল অঞ্চল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে মহিষ

চলনবিল অঞ্চল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে মহিষ

চলনবিলের মাঠে মহিষ চরাচ্ছেন কৃষক। ছবিটি তাড়াশের বেড়খাড়ি এলাকা থেকে তোলা সমকাল

এম. আতিকুল ইসলাম বুলবুল িতাড়াশ (সিরাজগঞ্জ)

প্রকাশ: ২৬ আগস্ট ২০২৪ | ২৩:৫৩

চলনবিল অধ্যুষিত সিরাজগঞ্জের তাড়াশের গুল্টা গ্রামের গোলাপুর পাড়ার বাসিন্দা আব্দুল জলিল কবিরাজ (৭০)। তাঁর বাড়িতে আছে ছোট-বড় ৯টি মহিষ। বাড়িতে মহিষ থাকাটাকে তিনি বনেদি কৃষক পরিবারের একটি গর্বের বিষয় মনে করেন।
চলনবিল অঞ্চলে চাষিদের কাছে মহিষের কদর সম্পর্কে জানাতে গিয়ে আব্দুল জলিল বলছিলেন, তাঁর দাদা ও বাবা কৃষিকাজ, যাতায়াত, ফসল আনা-নেওয়াসহ নানা কারণে গরুর পাশাপাশি বাড়িতে মহিষ পালন করতেন। এমনকি গত শতকের ৭০ ও ৮০ দশকেও চলনবিল এলাকার প্রতিটি গ্রামের সামর্থ্যবান কৃষক বা গৃহস্থের বাড়িতে গরু-ছাগলের সঙ্গে মহিষ ও মহিষের গাড়ি না থাকলে তাদের বনেদি গৃহস্থ বা কৃষক বলে মনে করা হতো না। গত শতকের শেষ দশকেও চলনবিলের সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, রায়গঞ্জ, উল্লাপাড়া, শাহজাদপুর, পাবনার ভাঙ্গুড়া, চাটমোহর, ফরিদপুর, নাটোরের গুরুদাসপুর, সিংড়া এবং নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলার এমন কোনো গ্রাম ছিল না, যে গ্রামে মহিষ ও মহিষের গাড়ির দেখা মিলত না।
কিন্তু চলতি শতকের শুরু থেকে দেশের অন্যান্য স্থানের মতো চলনবিল অঞ্চলেও যান্ত্রিক পরিবহন বেড়ে যাওয়া, ইঞ্জিনচালিত চাষযন্ত্র সহজলভ্য হওয়া, বেশি দুধ দেওয়া উন্নত জাতের গাভি লালন-পালন, মহিষ চরানোর মতো উন্মুক্ত বড় চারণভূমির অভাব, বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষের ফলে মহিষকে গোসল করানোর মতো পর্যাপ্ত পুকুর-জলাশয় না থাকা প্রভৃতি কারণে চলনবিল অঞ্চলে মহিষ লালন-পালনে অনেকে অনীহা দেখান।
তাড়াশের সেরাজপুর গ্রামের কলেজ শিক্ষক শফিউল হক বাবলু (৫৭) বলেন, বাংলাদেশের বৃহত্তম বিল চলনবিল এলাকায় এককালে শিশুদের মহিষের পিঠে উঠে ঘাস খাওয়ানো, পুকুরে গোসল করানো, মহিষের গাড়িতে আত্মীয় বাড়িতে যাওয়া, বৌউ-ঝিদের নাইয়রে (বেড়াতে) আনাসহ নানা মধুর স্মৃতি এখন অতীত। সে সময় কৃষিকাজে জমি চাষ, মই দেওয়া, যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের কাজে মহিষ এবং মহিষের গাড়ির বিকল্প ছিল না বললেই চলে। আবার গরু বা মহিষের গাড়ির জন্য পরিবেশ দূষণমুক্ত ছিল, তাও এ অঞ্চলের তরুণ প্রজন্মের অনেকেই জানে না।
চলনবিল অঞ্চলের কৃষি, কৃষি অর্থনীতির উন্নয়নসহ আর্থসামাজিক উন্নয়নে সার্বিক অবদানের গবাদি পশু মহিষ লালন-পালন এখনও হতে পাড়ে লাভজনক। এমনটিই মনে করেন চলনবিলের বারুহাস ইউনিয়নের বস্তুল গ্রামের কৃষক আব্দুল হালিম সরকার (৬৪)।
তাঁর ভাষ্য, চলনবিলের অনেক গ্রামেই আর মহিষ নেই। কিন্তু যেসব গ্রামের দু-চারজন কৃষক এখনও মহিষ লালন-পালন করেন তারা বোরো, রোপা আমন, রবিশস্যসহ নানা আবাদে জমি চাষের পর শুধু জমিতে মই দিয়েই অনেক টাকা আয় করেন। যেমন– এখন জমিতে মহিষ দিয়ে মই দিতে বিঘাপ্রতি ২০০ টাকা নেওয়া হয়। আর সারাদিনে ১২ থেকে ১৪ বিঘা জমিতে মই দেওয়া যায়। আবার চলনবিল এলাকার ফসলি মাঠ থেকে প্রতি আবাদের মৌসুমে রসুন, গম, সরিষা, ভুট্টা, আমন, রোপা, বেরো ধানের আঁটি কৃষকদের বাড়িতে পরিবহনে মহিষের গাড়ির ব্যাপক চাহিদা এখনও আছে।  
এ ছাড়া দই, মিষ্টি, পনির তৈরিতে কারিগররা গরুর দুধের চেয়ে অধিক ননিসমৃদ্ধ মহিষের দুধ কেনা লাভজন মনে করেন। মহিষের গোবর উৎকৃষ্ট জৈবসার হিসেবে এ এলাকায় কৃষকরা ব্যবহার করেন। বাড়িতে থাকা সে জৈবসার উচ্চ মূল্যে বিক্রিও হয়। এতে রাসানিক সারের চাহিদার ওপর চাপও কমে। পাশাপাশি মহিষের গোবর দিয়ে তৈরি ঘুটা বা জ্বালানি কাঠি বস্তা বা আঁটিপ্রতি ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে। এ ছাড়া বর্তমান সময়েও চলনবিল এলাকায় গরুর মাংসের চেয়ে মহিষের মাংস বেশি দামে বিক্রি হয়।
এ প্রসঙ্গে রায়গঞ্জ উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. অলিউর ইসলাম বলেন, চলনবিল একটি বৃহৎ এলাকা। চলনবিল অঞ্চল থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে গবাদি প্রাণী মহিষ। কিন্তু মহিষ লালন-পালনের মাধ্যমে চলনবিল এলাকার গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতি শক্তিশালী হতে পারে। সে সুযোগ বিল এলাকায় এখনও আছে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহিষ উন্নয়ন প্রকল্প আছে। তবে চলনবিল এলাকায় ওই প্রকল্প শুরু হয়নি। আর সে প্রকল্প শুরু হলে চলনবিল অঞ্চলে মাংস ও দুধের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে অধিক উৎপাদন দক্ষতা ও প্রজনন ক্ষমতাসম্পন্ন মহিষের জাত উন্নয়ন করা সম্ভব হবে। মহিষ পালনের মাধ্যমে চলনবিল এলাকায় দরিদ্র পরিবারগুলো সাবলম্বী হতে পারবে।

আরও পড়ুন

×