ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

আগুন-লুটপাট, ‘নিখোঁজ’ ১৭৫ জনের পরিণতি কী

গাজী টায়ার ফ্যাক্টরিতে ক্ষতি অন্তত ৮ হাজার কোটি টাকা

আগুন-লুটপাট, ‘নিখোঁজ’ ১৭৫ জনের পরিণতি কী

কারও হাতে এনআইডি, কারও মোবাইলে ছবি– সবাই এসেছেন স্বজনের খোঁজে। রোববার রূপগঞ্জের গাজী টায়ার ফ্যাক্টরিতে আগুন লাগলে সেখানে আটকে পড়া মানুষের খোঁজে ভিড় -মাহবুব হোসেন নবীন

সাহাদাত হোসেন পরশ, শরীফ উদ্দিন সবুজও জিয়াউর রাশেদ, রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) থেকে

প্রকাশ: ২৭ আগস্ট ২০২৪ | ০১:২৬ | আপডেট: ২৭ আগস্ট ২০২৪ | ০৮:১০

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের রূপসী এলাকা। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের তারাব থেকে রূপসী পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার রাস্তার দু’পাশে সোমবার দিনভর ছিল মানুষের আহাজারি। বাবা এসেছেন ছেলের খোঁজে, স্ত্রী খুঁজছেন স্বামীকে; ভাইকে না পেয়ে মূর্ছা যাচ্ছিলেন বোন। অনেকের হাতে নিখোঁজ ব্যক্তির ছবি ও জাতীয় পরিচয়পত্র। সংবাদকর্মী দেখলেই এগিয়ে এসে শোনাচ্ছিলেন কষ্টের কথা। পাশাপাশি অনুরোধ করছিলেন যেন ‘নিখোঁজ’ তালিকায় তাদের স্বজনের নাম লেখা হয়।

রোববার রাত ৮টার দিকে রূপসীতে গাজী টায়ার কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর আশপাশের ১৭৫ জনের খোঁজ মিলছে না। তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা স্পষ্ট করে কেউ বলতে পারছেন না। সবার মনেই তাদের বেঁচে থাকা নিয়ে সংশয়।

সোমবার সন্ধ্যা ৭টাতেও টায়ার কারখানার ছয়তলা একটি ভবন থেকে আগুনের কুণ্ডলী বের হতে দেখা যায়। আগুনের ভয়াবহতা ও স্বজনের খোঁজ না পাওয়া আহাজারির মধ্যেই অনেককে দেখা যায় কারখানার ভেতর থেকে সরঞ্জাম লুটপাট করতে। রাতে আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও কারখানার পোড়া ধ্বংসস্তূপের ভেতরে খোঁজ নেওয়া সম্ভব হয়নি।

কেউ কেউ মেশিনপত্র নিয়ে বের হচ্ছেন, কেউ আবার দামি আসবাবপত্র মাথায় নিয়ে ছুটছেন। অনেক নারী-পুরুষকে যন্ত্রাংশ, স্টিল, প্লাস্টিক ও তামা লুট করতে দেখা যায়। কাউকে কাউকে বাথরুমের কমোড নিতে দেখা গেল। কারখানার সামনের অংশে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও শিক্ষার্থীদের অবস্থানের কারণে লুটপাট হচ্ছিল না। কিন্তু ৯৬ বিঘার বিশাল কারখানার অন্যান্য অংশ অরক্ষিত থাকায় দেদার লুট চলছে।

লুটপাটে অংশ নেওয়া চারজনের সঙ্গে কথা হয়। নাম-পরিচয় জানতে চাইলে ক্ষিপ্ত হন। এসব সরঞ্জাম সরিয়ে নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে একজন তেড়ে আসেন। আরেকজন বলেন, ‘গাজী (কারখানার মালিক গোলাম দস্তগীর গাজী) অনেকের জমি-জায়গা দখল করছে।’  

প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, যারা নিখোঁজ রয়েছেন, তাদের অধিকাংশই লুটপাট করতে গিয়েছিলেন। কেউ কেউ উৎসুক হিসেবে ছবি ও ভিডিও করতে গিয়েছিলেন।  

এদিকে রাতে ফায়ার সার্ভিস এক খুদে বার্তায় জানায়, সোমবার সন্ধ্যা ৭টা ৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এর আগে সংস্থাটির পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেজাউল করিম বলেন, ‌‘যারা দাবি করছেন যে তাদের পরিবারের সদস্যরা নিখোঁজ রয়েছেন, আমরা তাদের একটি খসড়া তালিকা তৈরি করেছি। এ মুহূর্তে তা যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ নেই। স্বজনরা যারা দাবি করছেন, তাদের নাম-ঠিকানা লিখে রাখছি।’

রেজাউল করিম বলেন, ‘রাতে গাজী টায়ার কারখানায় আগুন লাগার খবর পেয়ে আমরা কাজ শুরু করি। কারখানার কাঁচামাল রাবার প্লাস্টিক হওয়ায় আগুন ফ্যাক্টরির চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এখান থেকে ১৪ জনকে উদ্ধার করতে পেরেছি। তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা কেউ এই কারখানার শ্রমিক বা কর্মচারী নন। তারা খুব সম্ভবত এখানকার মালপত্র সরিয়ে নেওয়ার জন্য এসেছিলেন।’

গাজী টায়ার কোম্পানির ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) সাইফুল ইসলাম সমকালকে বলেন, রোববার সকাল ১০টার দিকে কারখানার দু’দিক থেকে দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে কয়েকশ লোক ভেতরে ঢুকে পড়ে। এর পর তারা কোম্পানির সিকিউরিটি গার্ডসহ সব কর্মীকে অবরুদ্ধ করে। রাত ৮টার দিকে প্রথমে পলি সেকশনে আগুন দেয়। ১০টার দিকে ছয়তলার ভবনে আগুন দেওয়া হয়। ওই ভবনটিতে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য ছিল। সেটি মিক্সার ভবন নামে পরিচিত।

সাইফুল ইসলাম জানান, ৫ আগস্টের পর থেকে কারখানাটি বন্ধ ছিল। ওই দিন কারখানার একটি বড় অংশ পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এর পর নিরাপত্তার জন্য শুধু কিছু কর্মী থাকত। রোববার দুই গ্রুপে যারা কারখানায় ঢুকেছিল, লুটপাট নিয়ে তাদের নিজেদের মধ্যে মারামারি হয়। এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে কোপাকোপি শুরু হয়। দুই গ্রুপ যখন মারামারি করছিল, তখন আমাদের কর্মীরা কারখানা থেকে বের হয়ে যায়।
ব্যবস্থাপক জানান, কারখানাটিতে ২ হাজার ৩০০ শ্রমিক কাজ করতেন। তাঁর দাবি, অন্তত আট হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এটি আরও বাড়তে পারে।

‘নিখোঁজ’ ব্যক্তিদের মধ্যে ৩০ জনের স্বজনের সঙ্গে কথা হয়েছে সমকালের। তাদের মধ্যে ২৯ জন বাইরে থেকে এসে ওই কারখানায় ঢোকেন। একজন ওই কারখানার কর্মী। আগুন লাগার খবর শুনে বাসা থেকে এসে তিনি নিজ কর্মস্থলে ঢুকেছিলেন।

নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনরা জানান, রোববার থেকে তাদের স্বজন নিখোঁজ। তাদের মোবাইল ফোন বন্ধ। গতকাল রাত পর্যন্ত ১৭৫ জন নিখোঁজ থাকার তথ্য জানান স্থানীয় বাসিন্দারা।

গাজী টায়ার কারখানায় উদ্ধারকারী হিসেবে অনেক ছাত্রকে দেখা যায়। তাদের একজন সাব্বির হোসেন বলেন, গোলাম দস্তগীর গাজী আটক হওয়ার খবর শুনে অনেকে কারখানার ভেতর লুটপাট করতে ঢোকে। কেউ কেউ তাঁর ওপর আগে থেকেই ক্ষিপ্ত ছিল। এলাকার অনেক মানুষের জমি কম দামে কিনে কারখানা বর্ধিত করেছেন। রোববার রাতে যারা কারখানায় গিয়েছিল, তাদের অনেককেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

রেজাউল করিমের খোঁজে আহাজারি করে পলি আক্তার বলেন, ‘বাজার-সদাই নিয়ে রোববার রাইতে আমার স্বামী বাসায় আইছিল। পরে অনেকের সঙ্গে গাজীর কারখানায় যায় সে। রাত  থাইক্যা খুঁজতাছি। আমার বাচ্চারা কি এতিম হয়ে যাইব? তার হাড্ডিগুলা কি পামু?’

নাতি নিরবকে (১৭) খুঁজতে এসেছিলেন সুরাইয়া। নিরব যাত্রামুড়া এলাকার নবীন কটন মিলে কাজ করেন। যাত্রামুড়া গাজী টায়ার কারখানা থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে। সুরাইয়া জানান, মিল্লাত নামে এক বন্ধু তাঁকে ডেকে এনেছিলেন। এখন মিল্লাতও নিখোঁজ।

কারখানার সামনেই দুই বছরের ছেলে আদনানকে নিয়ে বিলাপ করছিলেন গৃহবধূ মোসা. রুবি। তিনি জানান, তাঁর স্বামী মো. সজীবের সঙ্গে রোববার রাত ৯টায় শেষবার কথা হয়েছে। তখন তিনি ভেতরেই ছিলেন। কারখানায় লুটপাট হচ্ছে শুনে তিনি এসেছিলেন। পরে আর তাঁর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি উপজেলার মুড়াপাড়া গঙ্গানগর এলাকার শহীদ মিয়ার ছেলে। সজীব রাজমিস্ত্রির সহযোগী হিসেবে কাজ করেন।

একই জায়গায় বিলাপ করছিলেন রূপসীর মইকুলি এলাকার সজীব ভূঁইয়ার স্ত্রী কন্না আক্তার। তিনি জানান, তাঁর স্বামী জামদানি ব্যবসায়ী। তাদের কারখানার শ্রমিক সাদ্দাম কারখানা লুটপাটের সময় আসেন। তাঁর খোঁজে রাত ১০টায় কারখানায় আসেন সজীব। রাত সাড়ে ১০টার দিকে তিনি মাকে ফোন করে তাঁকে বাঁচানোর আকুতি জানান। এর পর আর সজীবের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।

পুরো কারখানা ঘুরে দেখা গেল, চারদিকে পোড়া ধ্বংসস্তূপ। সেনাবাহিনীর সদস্যরা ভেতরে রয়েছেন। শিল্প পুলিশের সদস্যদের সেখানে দেখা গেল। ঘটনাস্থলে দায়িত্বরত শিল্প পুলিশের পরিদর্শক রাজ্জাকুল হায়দার সমকালকে বলেন, ৫ আগস্ট প্রথম দফায় কারখানা পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সর্বশেষ রোববার যেখানে আগুন লেগেছে, সেখানে কেমিক্যাল ছিল।

স্থানীয় ফল ব্যবসায়ী মো. জুয়েল রূপসী এলাকার বাসিন্দা। রোববার রাতে নূর নামে এক যুবকের সঙ্গে তিনি কারখানায় ঢুকেছিলেন। জুয়েল বলেন, আগুন লাগার খবর পেয়ে আমরা ভিডিও করার জন্য কারখানার ভেতরে ঢুকেছিলাম। নূর আমার দূরসম্পর্কের আত্মীয়। কারখানায় ঢোকার পরপরই তিনি তিনতলায় উঠে যান। আমি দোতলায় ছিলাম। মিনিট দশেক সেখানে থাকার পর পরিস্থিতি বুঝে বেরিয়ে আসি। আরেকটু দেরি হলে প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারতাম না। এর পর নূরকে কল করে তাঁর ফোন বন্ধ পাই। আশপাশের সবাই লুটপাটে ব্যস্ত ছিল। যে ভবনটিতে আগুন লেগেছে, সেটি ছয়তলা। কয়েকজনকে রশি দিয়ে নামতে দেখেছি।

স্থানীয় এক দোকানি জানান, বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে গাজী গোলাম দস্তগীরের রিমান্ডের খবর ছড়িয়ে পড়ে। তখন রূপসী বাসস্ট্যান্ডে মোস্তাফিজুর রহমান ভূঁইয়া দীপুর লোকজন মিষ্টি বিতরণ করে। সন্ধ্যা ৬টার দিকে জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি কাজী মনিরের সমর্থকরা কয়েকশ মোটরসাইকেল নিয়ে মহাসড়কে একটি শোডাউন করে। তারা গোলাম দস্তগীরের কুশপুত্তলিকা পোড়ায়। এর কিছুক্ষণ পর গাজী টায়ারে আরেক দফা লুটপাট শুরু হয়। এর আগে তিন-চারশ লোক ধারালো অস্ত্র, লাঠিসোটা নিয়ে গাজী টায়ারে হামলা চালায়। রাত ৯টার দিকে প্রতিষ্ঠানের পেছন দিয়ে ঢোকা একদল লুটপাটকারী প্রতিষ্ঠানের দোতলায় আগুন লাগিয়ে দেয়। এতে ওপরে থাকা শ্রমিক ও লুটপাটকারীরা আটকে পড়ে।

এ ঘটনা সম্পর্কে জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও দলটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য কাজী মনিরুজ্জামান বলেন, ‘গাজী সাহেব অপরাধ করেছেন। এ জন্য তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন। আইন অনুযায়ী তাঁর বিচার হবে। কিন্তু তাঁর কারখানায় হামলা করা, আগুন লাগিয়ে দেওয়া সমর্থন করি না। কারণ এ কারখানা সবার। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে গাজী সাহেব আমার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দিয়েছেন। সেগুলো আমি আইনিভাবে মোকাবিলা করেছি। রাজনীতির সঙ্গে শিল্প প্রতিষ্ঠানের কোনো সম্পর্ক নেই।’

মোস্তাফিজুর রহমান দীপু বলেন, যারা এই কারখানায় আগুন দিয়েছে, তারা সন্ত্রাসী। সন্ত্রাসীদের ঠেকাতে তারাবো পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদকসহ ওয়ার্ড বিএনপির নেতারা ঠেকানোর চেষ্টা করেছেন। তারাই উল্টো হামলার শিকার হয়েছেন। এর ভিডিও আমাদের কাছে আছে।

রূপগঞ্জ থানার ওসি (তদন্ত) জুবায়ের হোসেন জানান, নিখোঁজদের কেউ এখনও থানায় রিপোর্ট বা জিডি করেনি। শিল্প পুলিশের পাশাপাশি জেলা পুলিশও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে দায়িত্ব পালন করছে।

কারখানা কর্তৃপক্ষের বক্তব্য
গাজী টায়ার কারখানার ভেতর কোনো শ্রমিক ছিলেন না বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির প্রশাসনিক কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম। তিনি জানান, রূপগঞ্জে গাজী গ্রুপের পাঁচটি কারখানায় ১০ হাজারের বেশি শ্রমিক কাজ করতেন। এখন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন কীভাবে দেওয়া হবে, তাদের কর্মসংস্থান কী হবে– তা নিয়ে সবাই শঙ্কায় রয়েছেন। কারখানাগুলোয় লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের কারণে সবাই বেকার হয়ে পড়েছেন।

 

আরও পড়ুন

×