ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

সবচেয়ে আত্মহত্যাপ্রবণ জেলায় মৃত্যু বাড়ছেই

ঝিনাইদহ

সবচেয়ে আত্মহত্যাপ্রবণ জেলায় মৃত্যু বাড়ছেই

ম্যাপ

 শাহারিয়ার রহমান রকি, ঝিনাইদহ 

প্রকাশ: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৩:৪৪ | আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ০৭:৫৩

ঝিনাইদহ সদর উপজেলার পানামী গ্রামের ১৯ বছর বয়সী এক তরুণী পোকা মারার ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। তিনি এখন জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ওই তরুণীর স্বজনরা জানান, তাঁর বাবা দিনমজুর। ১০ বছর আগে পার্শ্ববর্তী জিতেন্দ্রপুর গ্রামের এক ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের এক মাসের মধ্যেই তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। এরপর থেকেই দরিদ্র বাবার সংসারে আছেন তিনি। অভাবের সংসারে মাঝেমধ্যেই মা-বাবার সঙ্গে তাঁর বাগ্‌বিতণ্ডা হতো। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত রোববার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন তিনি। এই তরুণী বেঁচে গেলেও প্রতিনিয়ত এ জেলায় নিজের জীবন কেড়ে নিচ্ছেন বহু মানুষ। পারিবারিক, আর্থিক, দম্পত্য কলহসহ নানা কারণে আত্মহত্যা কিংবা জীবন কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন তারা। এ ক্ষেত্রে নারীর সংখ্যাই বেশি। 

বাংলাদেশের সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশের সবচেয়ে বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাটিতে। স্থানীয় গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে আত্মহত্যার হার প্রতি লাখে ৬ থেকে ১০ জন; যা উন্নত দেশের কাছাকাছি। তবে ঝিনাইদহে এ হার এক লাখে প্রায় ২১ জন।

গবেষণায় দেখা গেছে, এ জেলায় আত্মহত্যার সংখ্যা বাড়ছেই। ২০০৫ সালে জেলায় আত্মহত্যা করেন ১৪৮ জন, ২০০৬ সালে ১৯৫, ২০১৫ সালে ৩৫৯, ২০১৬ সালে ৩৮৮, ২০২১ সালে ২৯১, ২০২২ সালে ৩১৮ ও ২০২৩ সালে ৩২৮ জন। 

আত্মহত্যাবিরোধী স্থানীয় বেসরকারি সংগঠন সোসাইটি ফর ভলান্টারি অ্যাক্টিভিটিসের (সোভা) পরিচালক জাহিদুল ইসলাম বলেন, জেলায় আত্মহত্যা সার্বিক বিবেচনায় কমেনি। 

জেলা সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত বিষপান, গলায় দড়িসহ নানাভাবে আত্মহত্যার চেষ্টা করে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ৯৩৮ জন। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ২১ জনের। সোমবার হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের মহিলা ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেছে, আত্মহত্যার চেষ্টার পর চিকিৎসাধীন আছেন ৪ নারী। 

সোভার তথ্যানুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত আত্মহত্যা করেছেন ৮০ জন। ২০০৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত জেলায় আত্মহত্যা করেছেন ৫ হাজার ৪৫৩ জন। এ  সময়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন প্রায় ৪২ হাজার মানুষ। 

সদর হাসপাতাল ও সোভার তথ্যমতে, আত্মহত্যার চেষ্টাকারীদের মধ্যে ৬৫ শতাংশই নারী। তাদের মধ্যে ৭০ শতাংশের বয়স ১০ থেকে ৩০ বছর।  

সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ডা. নাঈম সিদ্দিকী জানান, অনেকেই বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক পান বা রশিতে ঝুলে আত্মহত্যার চেষ্টা করে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আসেন। তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া এবং প্রবাসীদের স্ত্রীদের আত্মহত্যার হার বেশি। এ ছাড়া পারিবারিক কিংবা অন্যান্য কারণেও মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। পাশাপাশি বৃদ্ধ বয়সে সন্তান বা পরিবারের অন্য সদস্যদের অবহেলায় বিষণ্নতায় ভুগে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন কেউ কেউ। তবে আত্মহত্যা প্রতিরোধে পারিবারিক সমর্থনই বেশি কার্যকর।

শোভার পরিচালক জাহিদুল ইসলাম বলেন, পারিবারিক কলহের কারণে ২৪ শতাংশ, মানসিক সংকটে ১৫ শতাংশ, দারিদ্র্যের শিকার হয়ে ৯ শতাংশ, প্রেমজনিত কারণে ৫ শতাংশ, যৌন নির্যাতনে ১.৭ শতাংশ মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করছেন। তবে আত্মহত্যার জন্য পারিবারিক কলহ সবচেয়ে বেশি দায়ী। 

জাহিদুল ইসলাম বলেন, আত্মহত্যা প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা জরুরি। ইউনিয়ন পরিষদ কিংবা প্রশাসনের মাধ্যমে বাল্যবিয়ে, যৌতুক রোধসহ নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাতে হবে। আত্মহত্যার প্ররোচনাকারীকে আইনের আওতায় আনতে হবে। মানসিক ভারসাম্যহীনতার ক্ষেত্রে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। সর্বোপরি পারিবারিক ও সামাজিক সংহতি বাড়াতে হবে। তাহলেই কমে আসবে আত্মহত্যা।

আরও পড়ুন

×