নিষিদ্ধ বেড় জালে মাছ শিকার চলছেই

হাকালুকি হাওর তীরবর্তী কুলাউড়ার সাদিপুর এলাকায় নিষিদ্ধ বেড় জাল দিয়ে মাছ শিকার করছেন স্থানীয় জেলেরা সমকাল
কুলাউড়া (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২২:৪৬
মিঠাপানির সর্ববৃহৎ উৎস হাকালুকি হাওরের প্রাকৃতিক ভারসাম্য টালমাটাল। বিশেষ করে অবাধে বেড়জাল, কারেন্ট জালের মতো নিষিদ্ধ উপকরণ ব্যবহারে মাছ শিকারের প্রবণতা অব্যাহত থাকায় বিপর্যস্ত হচ্ছে হাওরের স্বাভাবিক বাস্তুব্যবস্থা।
সম্প্রতি হাকালুকি হাওরের বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখা গেছে, প্রশাসনের অভিযান এবং সচেতনতামূলক কার্যক্রম চলমান থাকলেও স্থানীয় জেলেদের একটি বড় অংশ নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার করে মাছ শিকার করছে হাওরে; যার কারণে হুমকির মুখে পড়েছে হাকালুকি হাওরের মৎস্য সম্পদ, জলজ উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্য।
মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলার মধ্যে অবস্থিত এ হাওরে দুই যুগ আগেও অন্তত ১১০ প্রজাতির দেশীয় মাছ ছিল; যা এখন ৫০ প্রজাতির কোটায় এসে ঠেকেছে। হাওর থেকে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে মাগুর, রিটা, নানিদ, বাঘাইড়, চিতল, রানীর মতো দেশীয় মাছের প্রজাতি। এ ছাড়া মাখনা, পদ্ম, সিঙরা, শাপলা, বনতুলসী, নলখাগড়া, হেলেঞ্চা, বন্ধুয়া, চাল্লিয়াসহ শতাধিক প্রজাতির জলজ উদ্ভিদও হারিয়ে যেতে বসেছে হাওরের সংকটাপন্ন প্রতিবেশের কারণে।
হাওরের প্রতিবেশ নিয়ে কার্যক্রম চালানো একাধিক সংস্থার সূত্রে পাওয়া তথ্য বলছে, বর্ষাকালে নিয়মিত বেড়জাল ও নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল ব্যবহার করে মাছ শিকার করা হচ্ছে এই জলাধারে। দলবদ্ধভাবে জেলেরা বড় নৌকা নিয়ে মাছ শিকার করেন বিভিন্ন বিলে। আগে বেড়জালের দৈর্ঘ্য এক থেকে দেড় হাজার ফুট ছিল আর ব্যাস বড় ছিল। এখন জেলেদের ব্যবহৃত জালের দৈর্ঘ্য ৩ থেকে ৪ হাজার ফুট করা হয়েছে। কমানো হয়েছে ব্যাস; যার কারণে বড় মাছের সঙ্গে পোনা মাছও ধরা পড়ে এসব জালে। মা মাছ শিকারের কারণে হাওরে মাছের বংশবিস্তার ব্যাহত হচ্ছে, নষ্ট হচ্ছে অভয়ারণ্য। এতে ব্যাপক হুমকির মুখে রয়েছে মাছের স্বাভাবিক প্রজনন।
হাকালুকি হাওর তীরবর্তী কুলাউড়ার সাদিপুর, জুড়ী অংশের শাহপুর, বেলাগাঁও গ্রামে ৩ হাজার মৎস্যজীবী পরিবারের বসবাস। হাওর থেকে
মাছ শিকার করে এসব মৎস্যজীবী জীবিকা
নির্বাহ করেন। বর্ষাকালে হাওরজুড়ে পানি থাকে চার-পাঁচ মাস। এ সময় জেলেরা বড় বেড়জাল ও নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল ব্যবহার করে হাওরের নাগুয়া, ফুট বিল, চকিয়া বিল, চাতলা বিল, কাংলি, গোবকুড়ি বিলসহ অর্ধশতাধিক বিল এলাকায়
মাছ শিকার করেন।
স্থানীয় পরিবেশকর্মী খোরশেদ আলম জানান, হাকালুকি হাওরে বেড়জাল দিয়ে মাছ ধরছেন জেলেরা; যার জন্য বর্তমানে হাওরের প্রতিবেশ অতিসংকটাপন্ন। অপরদিকে নানা দূষণে হাওরের জীববৈচিত্র্য রয়েছে হুমকির মুখে। বর্ষাকালে হাকালুকিতে নানা প্রজাতির দেশি মাছের প্রজননকালেও অবাধে মাছ শিকার চলে। নিষিদ্ধ জালে মা মাছ ও পোনা মাছ ধরা পড়ায় মৎস্য সম্পদ নষ্ট হচ্ছে ব্যাপকভাবে। হাওরের প্রতিবেশ রক্ষায় পরিকল্পিতভাবে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা আবশ্যক।
বেসরকারি সংস্থা সিএনআরএসের প্রকল্প কর্মকর্তা তৌহিদুর রহমান জানান, জেলেরা যেসব বেড়জাল ব্যবহার করেন, এসব জালের ছিদ্র খুব ছোট। এ ছাড়া কারেন্ট জাল, নেট জাল দিয়েও ধরা হচ্ছে মা ও পোনা মাছ। ১৫ বছর আগে হাওরে ২৫টিরও বেশি অভয়াশ্রম ছিল। বর্তমানে অভয়াশ্রমের সংখ্যা মাত্র ১১টি। এর মধ্যে মাত্র তিনটিতে মাছ শিকার বন্ধ রয়েছে। অবাধে বেড়জাল ব্যবহারে হাওরের জলজ উদ্ভিদও বিনষ্ট হচ্ছে।
কুলাউড়া উপজেলার জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা আবু মাসুদ জানান, ২২ সেপ্টেম্বর হাকালুকি হাওরের আছুরিঘাট পয়েন্টসহ বিভিন্ন অংশে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এতে প্রায় ৫ হাজার মিটার নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল ও বেড় জাল জব্দ করে পোড়ানো হয়েছে। হাওরের মৎস্য ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় তদারকি ও অভিযান অব্যাহত থাকবে।
অভিযান পরিচালনার বিষয়ে কুলাউড়ার সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহ জহুরুল হক জানান, হাকালুকি হাওরে অবৈধভাবে নিষিদ্ধ জাল দিয়ে মৎস্য আহরণের খবর পেয়ে রাতে অভিযান চালানো হয়। স্থানীয়রা সচেতন না হলে এভাবে হাওর ও তার জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা কঠিন।
- বিষয় :
- মাছ নিধন