সাত গ্রামে বানরের উৎপাত

গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার পানবরাইদ গ্রামে সোমবার ঘুরে বেড়াচ্ছে খাদ্যসন্ধানী বানরের দল সমকাল
মো. আ. কাইয়ুম, কাপাসিয়া (গাজীপুর)
প্রকাশ: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৩:৩৪
কাপাসিয়ার বরাইদ গ্রামে মুদি দোকান রয়েছে মো. বিপুলের (৩০)। বানরের উপদ্রবে অতিষ্ঠ হয়ে দোকানের শাটারের সামনে চিকন লোহার নেট দিয়েছেন। না হলে মালপত্র নিয়ে যায় বানরেরা। একই অবস্থা অন্য সব দোকানেও। কোনো দোকানে চিকন লোহার নেট, কোনোটিতে আবার প্লাস্টিকের নেট। তবে বিপুলের মতো দোকানিরা এতেও নিস্তার পান না। দোকান বন্ধ করে গেলে ফাঁকফোকর দিয়ে হাত ঢুকিয়ে পণ্য বের করে নেয় বানরেরা।
বরাইদ গ্রামটি পড়েছে কাপাসিয়ার দুর্গাপুর ইউনিয়নে। এই ইউনিয়নের দড়িমেরুন, পানবরাইদ, রাওনাট ও দুর্গাপুর; কাপাসিয়া সদর ইউনিয়নের নাকাসিনি ও পাঁচরুখি গ্রামের মানুষ খাদ্যসন্ধানী বানরের উৎপাতে অতিষ্ঠ। এসব গ্রামে অন্তত পাঁচ শতাধিক বানরকে গতকাল সোমবার ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। এলাকাবাসী জানিয়েছেন, খাবারের সন্ধানে ছুটে বেড়ানো বানরের হাত থেকে ফল ও ফসল রক্ষা করতে ব্যর্থ হচ্ছেন তারা। বানর তাড়াতে গিয়ে এক মাসে প্রায় ২০ জন মানুষ মারাত্মক আক্রমণের শিকার হয়েছেন।
গ্রামগুলোর জমিতে বানরের কারণে কোনো ধরনের ফল, ফসল ও শাকসবজি উৎপাদন করা যায় না। এলাকাবাসীর ভাষ্য, তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন বাধাগ্রস্ত করছে। তারা সমস্যার সমাধান চেয়ে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলে আবেদন জানিয়েও কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না। অন্যদিকে খাদ্য সংকটে পড়া বানরদের বেশির ভাগই ভুগছে অপুষ্টিতে। দ্রুত সময়ের মধ্যে এসব বানরকে সরিয়ে নেওয়ার দাবি তাদের।
জানা গেছে, এক সময় এসব বানর ওই এলাকার বিশাল বিশাল বনে থাকত। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বন উজাড় হওয়ায় খাদ্য সংকটে পড়ে দল বেঁধে লোকালয়ে চলে এসেছে। রাওনাট বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সফিকুল ইসলাম আঙ্গুরের ভাষ্য, বন-জঙ্গলে বানরেরা খাদ্য সংকটে পড়েছে। ফলে বাড়ি বাড়ি হানা দিচ্ছে। দরজা খোলা থাকলে মুহূর্তের মধ্যেই রান্না করা ভাত-তরকারি, ধান-চাল, মুড়ি, ফলমূল, শাকসবজিসহ খাদ্যসামগ্রী নিয়ে চোখের পলকেই চম্পট দিচ্ছে বানরেরা। রান্নার সময় গৃহিণীরা রান্নাঘর থেকে সরলে বা একটু অন্যমনস্ক হলেও নিমিষেই খাবার নিয়ে যায়।
সফিকুল বলেন, খাবার ঘরের দরজা খোলা থাকলে বানরেরা খাবার নিয়ে চলে যায়। গাছ কিংবা ঘরের চালে বসে খাবার খেয়ে পাতিল ফেলে দেয়। এক মাসে রাওনাট গ্রামের দুই শিশু ও দুই নারীসহ অন্তত ১১ ব্যক্তি বানরের আক্রমণের শিকার হয়েছেন। দুই শিশু ও একজন নারী বানরের কামড়-খামচিতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন। তাদের হাসপাতালে গিয়ে ইনজেকশন নিতে হয়েছে। এক নারী বানরের হামলা থেকে বাঁচতে দৌড় দেওয়ার সময় পড়ে হাত ভেঙেছেন। প্রতিদিনই কেউ না কেউ আক্রমণের শিকার হচ্ছেন।
বরাইদ গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য দিলীপ কুমার ধরের (৬৫) ভাষ্য, সাতটি গ্রামে পাঁচ শতাধিক বানর বসবাস করে। এসব এলাকার উর্বর জমিতে শাকসবজি ও ফলমূল প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হয়। অথচ বানরের কারণে তারা বেল, চালতা ও শিম ছাড়া অন্য কোনো ফল ও ফসল ঘরে তুলতে পারেন না। বাধ্য হয়ে সব কিনে খেতে হয়।
একই গ্রামের শোভন চৌধুরী বলেন, কেনাকাটা করে বাড়ি যাওয়ার পথেও অনেক সময় ক্ষুধার্ত বানরেরা জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেয়। বাড়ির উঠানে জামাকাপড় শুকাতে পারেন না। অধিকাংশ টিনের ঘরের চালে শত শত বানর দিনরাত ছোটাছুটি করে। বিভিন্ন মহলে এলাকাবাসী আবেদন জানালে সাময়িক খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। তবে পরবর্তী সময়ে বানরেরা আরও বেশি হিংস্র হয়ে ওঠে। যদি এদের স্থায়ীভাবে পুনর্বাসন করা হতো অথবা সাত গ্রামের জঙ্গলের কাছে ঘর বানিয়ে প্রতিদিন খাবার দেওয়া যেত, তাহলে বানরগুলো সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে পারত। পাশাপাশি গ্রামের মানুষের জীবনও শান্তিপূর্ণ হতো।
কাপাসিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এ কে এম লুৎফর রহমান এসব বানর পুনর্বাসনে বন বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগের
আশ্বাস দেন। বন বিভাগের রাজেন্দ্রপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা জুয়েল রানা জানান, তিনি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। শিগগির এ বিষয়ে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে আশাবাদী।
- বিষয় :
- বানর