শ্রমিক নিহত আহত ৩০
সংঘর্ষ গুলিতে ফের অশান্ত আশুলিয়া
৯ গাড়ি ভাঙচুর, আটক ৫১

ফাইল ছবি
সমকাল প্রতিবেদক, ঢাকা ও সাভার
প্রকাশ: ০১ অক্টোবর ২০২৪ | ০১:০১ | আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০২৪ | ১১:৩৫
শ্রমিকের ১৮ দফা মেনে নেওয়ায় কয়েক দিন শান্ত ছিল সাভারের আশুলিয়া শিল্পাঞ্চল। গতকাল সোমবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে শ্রমিকদের দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘাতে ফের অশান্ত হয়ে ওঠে আশুলিয়ার টঙ্গিবাড়ী এলাকা। এ সময় গুলিতে কাউসার আহাম্মেদ (২৬) নামে এক শ্রমিক নিহত হয়েছেন। চারজন গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছেন অন্তত ৩০ জন। ৯টি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। হামলা-ভাঙচুরের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে নারীসহ অন্তত ৫১ জনকে আটক করা হয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আশুলিয়ার ৩১ কারখানার শ্রমিকদের গতকাল ছুটি দেওয়া হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী ও বিভিন্ন কারখানার শ্রমিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতারা জানান, গতকাল সকালে মণ্ডল নিটওয়্যার লিমিটেড কারখানা খুলে দেওয়া, দুই শ্রমিক নিখোঁজের অভিযোগ, শ্রমিককে মারধরসহ নানা বিষয় নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, শ্রমিক ও মালিকপক্ষের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় আলোচনা হয়। একপর্যায়ে শ্রমিকরা বাইরে বের হয়ে আসেন। এ সময় পাশের ন্যাচারাল ডেনিম ও ন্যাচারাল ইন্ডিগো কারখানায় মণ্ডল নিটওয়্যারের শ্রমিকদের আটকে মারধর করা হচ্ছে– এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ে। পরে এ দুটি কারখানার শ্রমিকরা কারখানা থেকে বের হয়ে মণ্ডল নিটওয়্যারের সামনে বিক্ষোভ করেন। এ সময় আশপাশের কিছু কারখানার শ্রমিকরাও বিক্ষোভে যোগ দেন। একপর্যায়ে র্যাব, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করেন শ্রমিকরা। হামলায় শিল্প পুলিশের এসপি সারোয়ার আলম গুরুতর আহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ শ্রমিকদের লাঠিপেটা করে। পরে শ্রমিকরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়লে পুলিশ কয়েক রাউন্ড টিয়ার গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। এ সময় উভয়পক্ষের সংঘর্ষে এক শ্রমিক নিহত এবং পুলিশসহ অন্তত ৩০ জন আহত হন। আহত কয়েকজনকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। নিহত কাউসার আহাম্মেদ টঙ্গিবাড়ী এলাকার ম্যাংগো টেক্স লিমিটেড কারখানায় সুইং অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার মধ্য রতনপুরে। এনাম মেডিকেলের চিকিৎসক এনামুল হক মিয়া জানান, কাউসারের তলপেটের বামপাশে গুলি লেগেছে। আহতদের মধ্যে একজনকে আইসিইউতে, আরেকজনকে সার্জারি বিভাগে ভর্তি করা হয়েছে। নয়ন ও রাসেল নামে দুই শ্রমিকের বুকে এবং পেটে গুলি লেগে পেছন দিয়ে বেরিয়ে যায়।
এদিকে সকাল ১০টার দিকে সার্ভিস বেনিফিট, ক্ষতিপূরণসহ বন্ধ কারখানা খুলে দেওয়ার দাবিতে প্রায় ৫ ঘণ্টা আশুলিয়ার নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের বাইপাইল ও ডিওএইচএস পয়েন্টে সড়ক আটকে বিক্ষোভ করে ডংলিয়ন ও বার্ডস গ্রুপের শ্রমিকরা।
শ্রমিকরা জানান, গত ২৭ আগস্ট এক নোটিশের মাধ্যমে বার্ডস গ্রুপ লে-অফ ঘোষণা দেওয়া হয়। নোটিশে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে কারখানায় কাজ না থাকায় অব্যাহতভাবে আর্থিক লোকসানের মধ্য দিয়ে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করার কথা জানায়। নোটিশে ২৮ আগস্ট থেকে গ্রুপটির আরএনআর ফ্যাশন্স লিমিটেড, বার্ডস গার্মেন্ট লিমিটেড, বার্ডস ফেডরেক্স লিমিটেড এবং বার্ডস এঅ্যান্ডজেড লিমিটেডের সব শাখার কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
শ্রমিকরা আরও জানান, আগস্টের বেতন ১০ সেপ্টেম্বর এবং ৩০ সেপ্টেম্বর সার্ভিস বেনিফিটসহ ক্ষতিপূরণ পরিশোধের দিন ধার্য করা হয়। চুক্তিমতো শ্রমিকদের বেতনের টাকা পরিশোধ করলেও ৩০ সেপ্টেম্বর সার্ভিস বেনিফিটসহ ক্ষতিপূরণের টাকা দেওয়ার জন্য রোববার নতুন করে আরও তিন মাস সময় চেয়ে নোটিশ দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। পরে নির্ধারিত সময়ে টাকা পরিশোধ না করায় শ্রমিকরা সড়ক আটকে বিক্ষোভ শুরু করেন।
এ ছাড়া ডংলিয়ন কারখানার শ্রমিকরা জানান, এ পর্যন্ত তিনবার অনির্দিষ্টকালের জন্য কারখানা বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। সোমবার থেকে আবার ১৩ (১) ধারায় কারখানা বন্ধের নোটিশ দেওয়ায় বন্ধ কারখানা খুলে দেওয়ার দাবিতে সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ করেছেন শ্রমিকরা।
এর আগে সকালে বন্ধ থাকা জিরাবো পুকুরপাড় এলাকার বন্ধ থাকা লুসাকা গ্রুপের বেক নিট লিমিটেড ও তাম্মাম ডিজাইন লিমিটেড কারখানার সামনে গিয়ে দেখা যায় যৌথ বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য বিশমাইল জিরাবো সড়কের উভয় পাশে অবস্থান করছেন।
পাশে চালু থাকা রাইজিং গ্রুপের অ্যাকটিভ কম্পোজিট কারখানার প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. তৌহিদুজ্জামান বলেন, সরকার এবং বিজিএমইএর নির্দেশনা অনুযায়ী সব দাবি মেনে নেওয়ায় আমাদের শ্রমিকরা শান্তিপূর্ণভাবে কাজ করছে। তবে পাশের বন্ধ থাকা লুসাকা গ্রুপের শ্রমিকসহ বহিরাগত লোকজন এসে গেটে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে ভাঙচুর চালায়। তখন বাধ্য হয়েই কারখানা ছুটি ঘোষণা করা হয়।
জিরাবো এলাকার পিএমকে হাসপাতালের অ্যাডমিন ম্যানেজার নাজিম উদ্দিন বলেন, আমাদের হাসপাতালে চার শ্রমিককে আহত অবস্থায় আনা হয়েছে। তাদের মধ্যে দু’জনের পায়ে গুলি লেগেছে। তাদের চিকিৎসা চলছে।
ন্যাচারাল ডেনিম কারখানার প্রশাসনিক কর্মকর্তা সবুজ হাওলাদার বলেন, আমাদের কারখানায় কোনো সমস্যা ছিল না। সকাল থেকেই শ্রমিকরা শান্তিপূর্ণভাবে কাজ করছিলেন। হঠাৎ শ্রমিকদের মধ্যে গুজব ছড়ায় মণ্ডল গার্মেন্টসের শ্রমিক মারা গেছে। এটা শুনেই সব শ্রমিক একসঙ্গে কারখানা থেকে বেরিয়ে যান।
আশুলিয়া থানার ওসি আবু বকর সিদ্দিক বলেন, শ্রমিক ও যৌথ বাহিনীর সংঘর্ষে সেনাবাহিনী ও র্যাবের ৯টি গাড়ি ভাঙচুর করেন শ্রমিকরা। হামলায় জড়িত সন্দেহে ৫১ জনকে আটক করা হয়েছে। আশা ও রুবেল নামে দুই শ্রমিক নিখোঁজের গুজব ছড়ানো হলেও আদতে কেউ নিখোঁজ হননি।
কোনাবাড়ীতে আটক ৮ যুবক
গাজীপুরের একটি পোশাক কারখানায় হামলা-ভাঙচুরের চেষ্টার অভিযোগে গতকাল বিকেলে কোনাবাড়ীর আমবাগ পি.এন. কম্পোজিট লিমিটেড কারখানার সামনে থেকে আট যুবককে আটক করা হয়েছে। তারা হলেন– সজীব হোসেন, আলাউদ্দিন, মঞ্জু মিয়া, সম্রাট হোসেন, মোশাররফ হোসেন, শাকিল হোসেন, হৃদয় মণ্ডল ও মোয়াজ্জেম আলী। যৌথ বাহিনীর সদস্যরা তাদেরকে কোনাবাড়ী থানায় হস্তান্তর করেছেন।
পুলিশ জানায়, দুপুরে এম এম নিটওয়্যার কারখানার শ্রমিকরা বিভিন্ন দাবিতে কোনাবাড়ী আমবাগ আঞ্চলিক সড়ক আটকে বিক্ষোভ করে। পরে তারা পি.এন. কম্পোজিট কারখানার সামনে গিয়ে ভাঙচুরের চেষ্টা চালায়। পরে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা ওই কারখানার মূল ফটক ও ভবনে ভাঙচুর করে।
নারায়ণগঞ্জে শ্রমিক বিক্ষোভ
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার জনি টেক্সটাইল কর্তৃপক্ষ ১ সেপ্টেম্বর থেকে কারখানা লে-অফের নোটিশ দেয়। এর প্রতিবাদে গতকাল নারায়ণগঞ্জে মিছিল বের করে কারখানাটির শ্রমিকরা। পরে বিকেল ৪টা পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করে তারা। এ সময় শ্রমিকরা মালিককে গ্রেপ্তার, অবৈধভাবে লে-অফ প্রত্যাহার এবং শ্রমিকদের বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধের দাবি জানান।
গাজীপুরে মহাসড়ক অবরোধ
গাজীপুর সদরের আর অ্যান্ড জি (বিডি) গার্মেন্টের শ্রমিকরা কারখানা খুলে দেওয়ার দাবিতে গতকাল মহাসড়ক অবরোধ করেন। সকালে শ্রমিকরা কাজে এসে কারখানার প্রধান ফটকে বন্ধের নোটিশ দেখতে পান। এতে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা কারখানার সামনেই বিক্ষোভ করতে থাকেন। পরে ভবানীপুর এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে গিয়ে বিক্ষোভ করেন। প্রায় আধা ঘণ্টা মহাসড়কে বিক্ষোভ করার পর পুলিশের অনুরোধে সড়ক থেকে সরে যান। এ সময় মহাসড়কের দু’দিকে যানজট দেখা দেয়।
নিরাপত্তা না পেলে কারখানা বন্ধ রাখতে চান মালিকরা
শ্রমিকদের ১৮ দফা দাবি মেনে নেওয়া এবং সরকারের তরফ থেকে বারবার আশ্বস্ত করার পরও আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলের পরিস্থিতি এখনও শান্ত হয়নি। গতকালও কয়েকটি কারখানায় হামলা হয়েছে। অনেক কারখানার শ্রমিক কাজে যোগ দেননি। এ অবস্থা চলতে থাকলে কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার কথা ভাবছেন মালিকরা। গতকাল সাংবাদিকদের সঙ্গে আশুলিয়ার পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময় সভায় সরকারের কাছে এ দাবি জানান তারা। রাজধানীর উত্তরায় বিজিএমইএ ভবনে অনুষ্ঠিত এ সভায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আব্দুল্লাহিল রাকিব।
স্থানীয় উস্কানিদাতা দুর্বৃত্তের হাত থেকে কারখানা বাঁচাতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়ে মালিকরা বলেন, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না হলে কারখানা খোলা হবে না।
সভায় ফ্যাশন ডটকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খান মনিরুল আলম শুভ বলেন, শিল্পে অস্থিরতার পেছনের অপরাধীদের চিহ্নিত করুন। কেন তারা এ ষড়যন্ত্র করছে, তা জানা দরকার। লুসাকা গ্রুপের চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান সরকার বলেন, অনেক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান রপ্তানি আদেশ বাতিলের কথা জানিয়ে দিয়েছে। বিশৃঙ্খলার শুরু থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে ধরনের সহযোগিতার আশা করেছিলাম, তা পাইনি। নিরাপত্তার অভাবে বাধ্য হয়ে কারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। এয়ার জিন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল কবির বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যথেষ্ট নিরাপত্তা দিতে না পারলে কারখানা চালাব না। এনভয় গার্মেন্টের পরিচালক শেহরিন সালাম ঐশী বলেন, আমরা এমন অসহায়– থানায় মামলা পর্যন্ত করতে পারি না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শক্ত পদক্ষেপ না নিলে পোশাক খাতের এ বিশৃঙ্খলা বন্ধ হবে না।
বিজিএমইএর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আব্দুল্লাহিল রাকিব বলেন, কিছু বহিরাগত ও শ্রমিক মিলে অসন্তোষ সৃষ্টি করায় গতকাল আশুলিয়ার ৩১টি কারখানায় ছুটি দিতে হয়েছে। সরকার-মালিক-শ্রমিক সমন্বয়ে ১৮ দফার যৌথ ঘোষণার পরও ছোট ছোট বায়না ধরে কাজ করা থেকে বিরত থাকছে কিছু শ্রমিক। এরা সাধারণ শ্রমিকদের ভুল বুঝিয়ে, গুজব ছড়িয়ে কারখানায় অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর চালাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও শিল্প পুলিশ এ ধরনের নৈরাজ্য মোকাবিলায় অতীতের মতো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না।
শ্বেতপত্র কমিটিকে বঞ্চনার কথা জানালেন শ্রমিক নেতারা
অতীতে দেশের যেটুকু উন্নতি হয়েছে, এর ন্যায্য হিস্যা পাননি শ্রমজীবীরা। ন্যায্য মজুরি থেকে তারা বঞ্চিত হয়েছেন। শ্রমিক নেতারা শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সঙ্গে বৈঠকে এ সব অভিযোগ তুলে ধরেছেন বলে জানিয়েছেন কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। গতকাল রাজধানীর পরিকল্পনা কমিশনের নাজিয়া-সালমা সম্মেলন কক্ষে শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলেন অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে দেশের ১৫টি ট্রেড ইউনিয়নের নেতা উপস্থিত ছিলেন।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও কালিয়াকৈর প্রতিনিধি)
- বিষয় :
- শ্রমিক নিহত