প্রান্তিক জনপদে উদ্বেগ

.
নুর উদ্দিন সুমন, চুনারুঘাট (হবিগঞ্জ)
প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২৪ | ২২:৪৯
সিলেট বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ চুনারুঘাট উপজেলার ৪৯ কিলোমিটার সীমান্তবর্তী এলাকাজুড়ে বেড়েছে চোরাচালান ও অনুপ্রবেশের প্রবণতা। একই সঙ্গে স্থানীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থাও নড়বড়ে। এমন অবস্থায় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের সক্রিয় উপস্থিতি নিশ্চিতে তাগাদা দিচ্ছেন স্থানীয়রা।
উপজেলার দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলের বিভিন্ন রুটে ব্যাপকভাবে সক্রিয় হয়েছে চোরাচালান চক্র। বেড়েছে অবৈধ অনুপ্রবেশ। কারণ গ্রাম, পাড়া, মহল্লায় গিয়ে সীমান্তরক্ষী বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে এ ব্যাপারে তৎপরতা চালানো অসম্ভব। অপরদিকে পুলিশ প্রশাসনের নড়বড়ে অবস্থা। এমন সময় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের সরিয়ে দেওয়া হলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ন্যূনতম নিরাপত্তাটুকুও আর থাকবে না– এমনটাই বলছেন স্থানীয় সচেতন মহল।
বিভিন্ন ইউনিয়নের প্রবীণ বাসিন্দাদের ভাষ্য, স্থানীয় ও জেলা পর্যায়ের জনপ্রশাসনের সঙ্গে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বোঝাপড়া সাবলীল বা সহজ নয়। ইউপি চেয়ারম্যানরা না থাকলে আকস্মিক ও গুরুতর কোনো ঘটনা তাৎক্ষণিকভাবে নিয়ন্ত্রণে কোনো অভিভাবক থাকবে না। উপজেলা ও পৌরসভা পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিরা এখন আর নেই। সে ক্ষেত্রে সাধারণের মুখপাত্র হিসেবে প্রশাসন বা রাষ্ট্র ব্যবস্থার সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের সঙ্গে সমন্বয় করে স্থানীয়দের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করার ক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ের সহায়তা শূন্যের কোটায় গিয়ে ঠেকবে, যা উদ্বেগজনক। সম্প্রতি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের অপসারণের বিষয়টি আলোচনায় আসায় এ নিয়ে আরও বেশি উদ্বিগ্ন স্থানীয়রা। তারা বলছেন, এমনটা হলে থমকে যাবে গ্রামীণ উন্নয়ন। বাড়বে সহিংসতা। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে। অনেকেই মনে করছেন, দৈনন্দিন জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনসহ অন্য যে কাজগুলো দৈনন্দিন করতে হয়, সেগুলোতে জনদুর্ভোগ ও গ্রামীণ পর্যায়ের উন্নয়ন কার্যক্রম থমকে যাবে। চুনারুঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আয়েশা আক্তার বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমাদের কাজের অন্যতম সহায়ক শক্তি। স্থানীয় পর্যায়ে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে চেয়ারম্যানদের। দেশের বর্তমান অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বজায় রাখার জন্য তাদের আবশ্যকতা রয়েছে। এ মুহূর্তে তাদের অপসারণ ঘটলে স্থানীয় পর্যায়ে বিশৃঙ্খলা ঘটতে পারে।’
এ বিষয়ে চুনারুঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কবির হোসেন জানান, উপজেলা পর্যায়ে গ্রামীণ উন্নয়নে বাল্যবিয়ে, যৌন হয়রানি ও মাদকের অপব্যবহার হ্রাসকল্পে ইউপি চেয়ারম্যানদের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। তাই দেশের চলমান পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি তাদের কার্যক্রম গতিশীল রাখতে হবে।
১ নম্বর গাজিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী জানান, প্রান্তিক লেভেলের প্রশাসন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ইউনিয়ন পরিষদ। বিশেষ করে গ্রাম্য আদালতের যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে পরিষদকে তার মাধ্যমে যে বিচার বৈঠক করা হয়, তাতে প্রশাসনের সিংহভাগ চাপ কমে যায়। এ আদালতে পারিবারিক নানা ইস্যুর সমাধান করা হয় সহজে। এসব কার্যক্রম চলমান থাকা জরুরি। এ মুহূর্তে যদি ইউনিয়ন পরিষদ ভেঙে দেওয়া হয়, তাহলে সাধারণ মানুষ বিপাকে পড়বে। যেসব ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা দায়িত্ব পাওয়ার পর এবং দায়িত্ব পাওয়ার আগে অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন অথবা তাদের বিরুদ্ধে বিচারাধীন মামলা-মোকদ্দমা চলমান রয়েছে এবং অফিসে বসতে পারছেন না, তাদের অপসারণ করা হোক। বাকিদের কাজের ক্ষেত্র সহনশীল করা আবশ্যক।
৫ নম্বর শানখলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম জানান, সাধারণ মানুষের যে ঘনিষ্ঠতা তাদের সঙ্গে, সেটা প্রশাসনের অন্য কোনো পর্যায়ে হয় না। গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি জনপদের সালিশ বিচার ও অপরাধ দমনে ইউনিয়ন পরিষদের সক্রিয়তা আবশ্যক।
৬ নম্বর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান চৌধুরী জানান, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা এবং পূজা উদযাপনে মন্দির রক্ষায় চেয়ারম্যানরা নিয়মিত সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিবছরই তারা এভাবে কাজ করেন। এভাবে তাদের অপসারণ করা মানে মানুষকে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া। উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মীর সীরাজ জানান, হাসিনা সরকারের আমলে সব নির্বাচন অবৈধ। তবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ করার আগে সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক, কে দায়িত্ব নেবেন। নইলে মানুষের ভোগান্তির দায় সরকারের কাঁধে বর্তাবে।
মিরাশি ইউনিয়নের সচিব সাধন ভট্টাচার্য ও পাইকপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সচিব মাসুদ আহমেদসহ একাধিক ইউনিয়ন পরিষদ সচিবদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, জমিসংক্রান্ত, স্বামী- স্ত্রী, পারিবারিক বিরোধ গ্রাম্য আদালতে সালিশ বিচারে চেয়ারম্যানগণের মুখ্য ভূমিকায় নিষ্পত্তি হয়। যদি চেয়ারম্যানদের অপসারণ করা হয়, তাহলে এগুলো সামাল দেওয়া অসম্ভব।
পাকুড়িয়া এলাকার সালিশ বিচারক হাজি দুলাল জানান, সরকার পতনের পর দাঙ্গা-হাঙ্গামা বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনিতেই প্রতিদিন বিচার সালিশ করেই তাদের দিন চলে যায়। চেয়ারম্যানদের সরিয়ে দিলে আইনশৃঙ্খলার ভয়াবহ অবনতি ঘটবে।
শিক্ষক ফয়সাল আহমেদ জানান, ইউনিয়ন পরিষদের সব কাজের কেন্দ্রবিন্দু চেয়ারম্যান। এক কথায় উন্নয়ন, রাজস্ব, প্রশাসনসহ ইউনিয়নের সব ধরনের কাজ তদারক করার দায়িত্ব তাদের। এই স্থানটা আকস্মিক শূন্য হয়ে গেলে পরিস্থিতি বেসামাল হয়ে পড়বে।
স্থানীয়রা বলছেন, গত সরকারের সব নির্বাচন অবৈধ হলে বর্তমান সরকারের আমলে সেই অবৈধ নির্বাচনের একজন প্রার্থীকে কীভাবে একটি সিটি করপোরেশনের বৈধ মেয়র ঘোষণা করা হয়। তাদের চেয়ে ইউপি প্রতিনিধিদের জনসম্পৃক্ততা আরও অনেক বেশি। তাদের জন্য কি দেশের আইন ভিন্ন?
- বিষয় :
- চোরাচালান