‘আমন আবাদ এখন আত্তির পেটে’

বন্যহাতির তাণ্ডবে নষ্ট হওয়া আমনের জমির দিকে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে এক কৃষক। ছবি: সমকাল
মিজানুর রহমান, নালিতাবাড়ী (শেরপুর)
প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর ২০২৪ | ১৮:২৭
‘কষ্ট কইরা এক একর জমিতে আমনের আবাদ করছিলাম। সেই আমন আবাদ এখন আত্তির (হাতির) পেটে চলে গেছে। ক্ষেত একেবারে তছনছ করে গেছে। আত্তি ধান না খাইলে আর ২০ দিন পরেই পাকাধান ঘরে তুলতে পারতাম। এক সপ্তাহ ধরে আত্তির পাল ক্ষেতের পাশে পাহাড়ের ঝোপে আইছে। সন্ধ্যা অইলেই পাহাড় থাইক্যা আত্তির পাল ক্ষেতে নাইমা আয়ে। পাহাড়া দিয়েও কাজ অয় নাই। সব ধান শেষ এখন। সামনের দিনে কেমনে চলমু, এই চিন্তায় ঘুম হারাম হয়েছে।’ আক্ষেপের সুরে এসব কথা বলেন কিষানি আশালতা নেংওয়া (৪৫)।
শুধু আশালতা নন, তার মতো শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার পানিহাটা ও ফেকামারী সীমান্তবর্তী এলাকার অর্ধশতাধিক কৃষকের অবস্থা একই রকমের। বন্যহাতির আক্রমণ থেকে ফসল রক্ষায় এখন নির্ঘুম রাত কাটছে তাদের।
শনিবার বিকেলে নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী পানিহাটার ফেকামারী ও তালতলা এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, ভারত সীমান্তের কাছে প্রায় ১০০ একর জমিতে অর্ধশতাধিক কৃষক আমন ধানের আবাদ করেছেন। এসব০ এলাকায় ধান পাকতে আরও দুই থেকে তিন সপ্তাহ সময় লাগবে। কিন্তু জমি থেকে ১০০ মিটার পূর্বে তালতলা দলদামা টিলায় এক সপ্তাহ ধরে ৪৫ থেকে ৫০টি ছোট-বড় সদস্যের একদল বন্যহাতি অবস্থান করছে। হাতির এই দলটি প্রায় প্রতিদিন উপজেলার পানিহাটা এলাকার মারং গোঁফ ও তালতলা দিয়ে নেমে আসছে ফসলের জমিতে। পানিহাটা মৌজার আমন আবাদ বিনষ্ট করে দিচ্ছে হাতি। গত কয়েকদিনে অব্যাহত হাতির অত্যাচারে পানিহাটায় বিনষ্ট হয়েছে অন্তত ১৭ জন প্রান্তিক কৃষকের প্রায় সাড়ে ৫ একর জমির আমন ধানক্ষেত। এতে দিশেহারা হয়ে পড়ছেন সীমান্তের কৃষকরা।
কিষাণী আশালতা নেংওয়া জানান, আমরা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ যুগ যুগ ধরে পাহাড়ে বসবাস করি। আমাদের বাপ-দাদারাও এই বনে থেকেছে। তবে গত কয়েক বছর ধরে হাতির আক্রমণ বেড়েছে। হাতিগুলোর জন্য বনে পর্যাপ্ত খাবারের ব্যবস্থা নেই, তাই তারা আমাদের ফসলের মাঠে হামলা করে ক্ষতি করে। যখন ফসলের জমিতেও খাবার না থাকে, তখন তারা আমাদের বাড়ি-ঘরে এসে হামলা করে। ক্ষেতে আমাদের ধান এখনও পাকেনি, কিন্তু হাতির আক্রমণের কারণে আমার পুরো ধানক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে। এতে আমরা আর্থিকভাবে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।
স্থানীয়রা জানান, দিনের বেলায় বুনো হাতির দল পাহাড়ের ভেতরে অবস্থান করে। বিকেলের দিকে আবার কোনোদিন সন্ধ্যার পর লোকালয়ে বেরিয়ে আসে। লোকালয়ে এসে খাবারের সন্ধানে ধান ক্ষেতে নামে।
কষ্টে ফলানো ধান রক্ষা করতে গিয়ে ঢাক ঢোল, মশাল জ্বালিয়ে হাতির দলকে তাড়িয়ে ফসল রক্ষার চেষ্টা করেন কৃষকরা। কিন্তু সবসময় তা হয়ে উঠে না। এ বিষয়ে কৃষক আব্বাস আলী জানান, হাতিদের তাড়াতে গেলেই আমাদের ওপর হামলা করে। এতে অনেকের প্রাণহানি হয়। এই বিশাল প্রাণিগুলোর কাছে আমরা অসহায়। তারা যখন ধান খায় তখন অনেক চেষ্টা করেও তাদের ফেরানো যায় না। আমরা প্রশাসনের কাছে আমাদের ফসলসহ নিজেদের নিরাপত্তা চাই।’
পানিহাটা এলাকার কিষানি মুর্শিদা বেগম বলেন ‘কষ্ট কইরা আবাদ করি। সেই আবাদে আত্তির মুখ লাগছে। আত্তির মুখ থাইকা ফসল বাচাঁনো দায়। ক্ষেতের পাশেই জঙ্গলে ৫০-৬০টি আত্তি গুড়াগুড়ি করতাছে। আত্তির পাল যহন তহন ক্ষেতে নাইমা পড়বে। রাইতে আত্তির পাল নাইমা অনেক কৃষকের ফসল খাইয়া গেছে। আমার ক্ষেতও অর্ধেক খাইছে। কি করমু! আত্তির জন্য তো অহন টেকা দায়। আবাদ খাইলে চলমু কেমনে? এ ছাড়া ফসল রক্ষার তো কোনো পথ নাই।’
ক্ষতিগ্রস্থ আব্দুল সোবহান, নুর মোহাম্মদ ও দুলাল মিয়াসহ কয়েকজন অভিযোগ করে বলেন, হাতির আক্রমণ শুরুর দিকে প্রশাসন বা জনপ্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে পাহাড়ি গ্রামবাসীদের মশালে ব্যবহারের জন্য কেরোসিন তেল বিতরণ করা হতো। কিন্তু এখন আর তা করা হয় না। হাতির কবল থেকে পাহাড়ি গ্রামবাসীদের রক্ষার্থে বন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সোলার ফেন্সিং স্থাপন করা হয়। কিন্তু ঠিকাদারের নিম্নমানের করা কাজ ও দেখভালের অভাবে সেটিও নষ্টের পথে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, আমন মৌসুমের শেষ দিকে এসে বন্যহাতির দল কৃষকের ফসল খেয়ে ও পা দিয়ে মাড়িয়ে বিনষ্ট কারার ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক। আমরা উপজেলা কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্থ ওই সকল কৃষকদের তালিকা প্রনয়ন করে সামনের বোরো আবাদে তাদেরকে সরকারিভাবে প্রণোদনার ব্যবস্থা করব।
ময়মনসিংহ বন বিভাগের মধুটিলা রেঞ্জ কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, কয়েকদিন থেকে ৪০-৪৫টির বন্য হাতির একটি দল পানিহাটা জঙ্গলে অবস্থান করছে। সন্ধ্যার পর পর হাতির দলটি ক্ষেতে নেমে ফসলি জমি পা দিয়ে নষ্ট করে ফেলেছে। আমি ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের নিয়ম মেনে ক্ষতিপূরণের জন্য আবেদন করতে বলেছি।
- বিষয় :
- বন্যহাতি
- বন্যহাতির আক্রমণ
- শেরপুর
- ধানের চারা