ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

ছাতক-কোম্পানীগঞ্জের সংরক্ষিত বনাঞ্চল

আগ্রাসী ভক্ষক, অসহায় রক্ষক

আগ্রাসী ভক্ষক, অসহায় রক্ষক

ফাইল ছবি

মুকিত রহমানী, সিলেট

প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৪ | ২২:৫৩

সিলেট বন বিভাগের ছাতক বিটের আওতাধীন ছাতক-কোম্পানীগঞ্জ এলাকায় সংরক্ষিত বনাঞ্চলের তালিকাভুক্ত ৪ হাজার ৮০০ একর জমির মধ্যে প্রায় ৬০০ একর জমি গিলে খেয়েছে ভক্ষকেরা। সংরক্ষিত বনাঞ্চলে প্রবেশের অনুমতি না থাকলেও ছাতক ও কোম্পানীগঞ্জ সীমান্ত এলাকার কয়েকটি গ্রামের শতাধিক বাসিন্দা বনের জমি দখলে নিয়েছে বেপরোয়াভাবে। কর্তৃপক্ষের বিধিনিষেধ তোয়াক্কা না করে সে জমি ভোগ করছেন তারা, চালাচ্ছেন হাল।
সূত্র জানায়, বনের জমি দখলে নেওয়া ব্যক্তিরা মূলত একটি চক্রের অংশীজন; যাদের নিয়ন্ত্রণ করেন বিশেষ মহলের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। বনভূমি দখলে নিয়ে কৌশলে তারা সেগুলো সাধারণ গ্রামবাসীর কাছে ইজারা দিচ্ছেন। তাদের অসচেতনতার সুযোগ নিয়ে চক্রটি সাধারণ মানুষকে জড়িয়ে ফেলছেন বনভূমি বেদখলের কারসাজিতে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পদক্ষেপ নিতে গেলে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে তাদের। ধূর্ত এই ভক্ষক চক্রের সামনে রীতিমতো অসহায় বন বিভাগের সংশ্লিষ্টরা।
সংরক্ষিত বনাঞ্চলের সীমানা নির্ধারণ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় প্রতি বছর বিভিন্ন জাতের গাছের চারা রোপণ করা হয় বন বিভাগের উদ্যোগে। তবে সেগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে পারছে না বিভাগের লোকজন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে গাছের চারা নষ্ট করে বনের জমি দখলে নিয়ে চাষাবাদ শুরু করে দখলদার বা তাদের ইজারাদারেরা। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি।
অভিযোগ রয়েছে, অন্যান্য বছরের মতো এবারও এ বনাঞ্চলের সীমান্তবর্তী এলাকা ঘিরে সরকারি বরাদ্দে গাছের চারা রোপণ করা হয়। কিছুদিন পরেই সেগুলো উপড়ে ফেলে সেই জমিতে চাষাবাদ শুরু করেন স্থানীয় কয়েকজন। গত ৩ নভেম্বর স্থানীয়দের এমন কাজে বাধা দিতে গিয়ে হুমকির মুখে পড়েন বন বিভাগের লোকজন।
শুধু বনের জায়গা দখল করে চাষাবাদ নয়, স্থানীয় চেলা নদীর ইছামতী এলাকায় একই বিটের জায়গা থেকে ড্রেজিং মেশিন দিয়ে চলছে বালু উত্তোলনও। বনের জায়গা উদ্ধার, বালু উত্তোলন বন্ধ ও প্রাণনাশের হুমকির প্রতিকার চেয়ে অসহায় বিট কর্মকর্তা বাধ্য হয়েছেন সেনাবাহিনী, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানা পুলিশের শরণাপন্ন হতে। এদিকে ছাতক সেনা ক্যাম্পে দায়ের করা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দখলদার পক্ষকে আলোচনায় ডাকা হয়েছে বলে জানা গেছে। 
বন বিভাগের তথ্য মতে, ছাতক বিটের আওতাধীন কোম্পানীগঞ্জের পশ্চিম ইসলামপুরের লম্বাকান্দি, বাগারপাড়, ছাতক উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের রহমতপুর, সৈয়দাবাদসহ কয়েকটি গ্রামের পাশে ৫০০ থেকে ৬০০ একর জায়গা রয়েছে। ইসলামপুর ইউনিয়নের রাজেন্দ্রপুর ও বাহারপুর মৌজার এসব জায়গার অংশ বিশেষ এলাকায় প্রতি বছরই বিভিন্ন জাতের চারা রোপণ করে বন বিভাগ। গত বছর কিছু জায়গা উদ্ধার করে ১৭২ একর জায়গাজুড়ে চারা রোপণ করা হয়। তবে সেই জায়গার মধ্যে বাগানের উত্তর ও পশ্চিম দিকে এবার প্রায় দুই একর জায়গার গাছ নষ্ট করে চাষাবাদ শুরু করা হয়। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। 
ছাতক বিট কর্মকর্তা আইয়ুব খান সমকাল প্রতিবেদককে জানান, চারা নষ্ট ও বনের জমি দখলে নিয়ে চাষাবাদের খবর পেয়ে তারা সেখানে যান। স্থানীয় ৩০ থেকে ৩৫ জন লোক এ সময় তাদের ওপর হামলার চেষ্টা চালায়। নিরাপত্তার স্বার্থে সেখান থেকে চলে আসতে বাধ্য হয় বন বিভাগের সংশ্লিষ্টরা। এ ঘটনায় সোমবার ৭ জনের নাম উল্লেখসহ স্থানীয় সেনা ক্যাম্পে অভিযোগ করা হয়েছে। পরদিন এ বিষয়ে ছাতক থানায়ও একটি লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে।
এদিকে বনভূমিতে অবৈধভাবে ড্রেজার স্থাপন করে বালু উত্তোলন বন্ধে ইউএনওর কাছে পৃথক একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে ২৯ অক্টোবর।
ছাতক থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গোলাম কিবরিয়া হাসান জানান, বনের জমি বেদখল, গাছের চারা নষ্ট ও হামলাচেষ্টার ঘটনায় বন কর্মকর্তা অভিযোগ জানিয়েছেন। তবে জায়গা উদ্ধারের বিষয়টি আদালতের এখতিয়ার। হুমকি বা বাধা প্রদানের বিষয়টি পুলিশ দেখছে।
স্থানীয়দের দেওয়া তথ্য মতে, শতাধিক গ্রামবাসীর দখলে রয়েছে বনের প্রায় ৬০০ একর জায়গা। তারা দীর্ঘদিন ধরে সেখানে সরিষা চাষসহ কৃষি কাজ করে আসছেন। একটি চক্রের মাধ্যমে এসব জমি বেদখল হয়ে কৌশলে সাধারণ গ্রামবাসীর হাতে আসে। সরাসরি দখলকৃত জমিতে কিছু না করে নিজেদের নিরাপদে রেখে ফায়দা লুটছে চক্রটি। ১৫ বছর ধরে বন বিভাগ বনের এসব জমি উদ্ধারে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে তা সম্ভব হচ্ছে না। কিছু অংশ উদ্ধার করলেও তা আবার বেদখল হয়ে যাচ্ছে।
বনভূমি বেদখল ও ইজারা দিয়ে ফায়দা ভোগের এ চক্রটিকে মদদ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ছাতকের ইসলামপুর ইউনিয়নের রহমতপুর গ্রামের ফারুক মিয়া ও আছরব আলী সওদাগরের বিরুদ্ধে। তাদের সঙ্গে রয়েছেন কোম্পানীগঞ্জের পশ্চিম ইসলামপুর ইউপি সদস্য কবির হোসেনসহ আরও কয়েকজন। সূত্রমতে, প্রতিটি গ্রামে তাদের আলাদা গ্রুপ করে এসব জায়গা দখল করে রাখা হয়েছে।
সোমবার থানা ও সেনা ক্যাম্পে দায়ের করা অভিযোগে ওই তিনজনের নাম ছাড়াও অভিযুক্তের তালিকায় রয়েছে কোম্পানীগঞ্জের চাটিবহর গ্রামের কুতুব আলী, গেদা মিয়া, লম্বাহাটির মোনাফফর, একরাম আলীসহ আরও ২৫ থেকে ৩০ জন। 
অভিযোগের বিষয়ে ইউপি সদস্য কবির হোসেন জানান, দীর্ঘদিন ধরে এলাকার মানুষ সেখানে চাষাবাদ করে আসছে। বন বিভাগ চারা রোপণ করে কিছু অংশে। তা আবার নষ্ট হয়ে যায়। ১৫ বছর ধরে বন বিভাগ সমস্যা সৃষ্টি করে চলছে। তাঁর দখলে বনের কোনো জায়গা নেই। তবে এসব নিয়ে সমস্যা হলে তিনি স্থানীয়দের সহায়তায় এগিয়ে যান।
আছরব আলী সওদাগরের দাবি, তারা কয়েকজন সেখানে কিছু জমি চাষাবাদ করেন। মাঝে মাঝে বেচা-বিক্রিও করেন। তাঁর দাবি, সেখানকার জমি সরকারের কাছ থেকে বন্দোবস্ত নিয়েছেন তিনি। এ সময় তিনি বন বিভাগের সংশ্লিষ্টদের হুমকি দেওয়া ও হামলাচেষ্টার অস্বীকার করেন।

আরও পড়ুন

×