চট্টগ্রামে এজাহার বাণিজ্য চিহ্নিত অপরাধীরাও বাদী

.
আব্দুল্লাহ আল মামুন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০২৪ | ০০:১৮
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন রিয়াদ ইখতিয়ার। চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলায় বিভিন্ন ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে চারটি মামলা হয়েছে বিস্ফোরক আইনে। গত সেপ্টেম্বরে করা মামলাগুলোয় যেসব ঘটনাস্থল উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে কখনও যাননি বলে দাবি করেছেন রিয়াদ। অনুসন্ধানে জানা যায়, মামলার পেছনে রয়েছেন বোয়ালখালী উপজেলা বিএনপির এক নেতা। তাঁর মেয়ের সঙ্গে বিয়েবিচ্ছেদের জেরে একের পর এক মামলায় রিয়াদকে আসামি করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। শুধু রিয়াদ নন; গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর চট্টগ্রামে হওয়া অনেক মামলায় সাধারণ মানুষকে আসামি করা হয়েছে। অধিকাংশ মামলার বাদী অনেক আসামিকে চেনেন না। চিহ্নিত অপরাধীও হয়েছেন মামলার বাদী।
আইনজীবীরা বলছেন, বিচার চাওয়ার জন্য নয়, এ ধরনের মামলা ঘিরে এজাহার বাণিজ্য হচ্ছে। পারিবারিক বিরোধ, প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা, হয়রানি ও চাঁদাবাজির জন্য মামলায় ঢালাওভাবে আসামি করা হচ্ছে। এ ধরনের উদ্দেশ্যমূলক মামলা করা ফৌজদারি অপরাধ।
ছাত্র হত্যা মামলার বাদীকে নিয়ে নানা প্রশ্ন
গত ১৮ জুলাই নগরের বহদ্দারহাটে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ, বিজিবি ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হৃদয় চন্দ্র তরুয়া। তাঁর বাড়ি পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলায়। মৃত্যুর ঘটনায় গত ২০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানায় মামলা করেন মোহাম্মদ আজিজুল হক। তাঁর বাড়ি চন্দনাইশের বৈলতলী গ্রামে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, আজিজুলের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ, বায়েজিদ বোস্তামী ও কক্সবাজার সদর থানায় মাদক, গাড়ি চুরি, চাঁদাবাজি ও পরিবেশবিষয়ক অভিযোগে ছয়টি মামলা রয়েছে।
আজিজুলের করা মামলায় ২০৬ জন আসামি। তালিকায় আছেন ছয় পুলিশ কর্মকর্তা ও চার সাংবাদিক। এজাহারে আজিজুল নিজেকে হৃদয় তরুয়ার বন্ধু বলে পরিচয় দিয়েছেন। এতে বলা হয়, হৃদয় তরুয়া ২৩ জুলাই সন্ধ্যা ৬টা ৪০ মিনিটে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তবে এ তথ্য সঠিক নয়। চিকিৎসাধীন হৃদয় তরুয়া মারা যান ওই দিন সকালে। এ ছাড়া একই মামলায় দুটি এজাহার হয়েছে। আসামির মধ্যেও পার্থক্য রয়েছে। মামলায় আসামি করা হয়েছে পুলিশ পরিদর্শক আবুল কাশেম ভূঁইয়াকে। তিনি ঘটনার সময় নরসিংদীর মনোহরদী থানার ওসি হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। ২০২০ সালের ২৪ ডিসেম্বর বিকেলে চোরাই গাড়িসহ নগরের পাঁচলাইশ থানা এলাকায় একটি গ্যারেজ থেকে আজিজকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তখন আবুল কাশেম পাঁচলাইশ থানার ওসি ছিলেন।
এ ছাড়া আসামি করা হয়েছে পুলিশ পরিদর্শক মো. মহসীনকে। ঘটনার সময় তিনি ছিলেন ঢাকার তেজগাঁও থানার ওসি। এ ছাড়া চট্টগ্রাম রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি নুরে আলম মিনা ও পুলিশ সুপার এসএম শফিউল্লাহকে আসামি করা হয়েছে। ঘটনাস্থল নগরের বহদ্দারহাট তাদের এখতিয়ারের এলাকা নয়।
এ মামলায় ১৪৮ থেকে ১৫১ নম্বর আসামি চারজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। তারা হলেন– দৈনিক আজাদীর সিনিয়র রিপোর্টার শুকলাল দাশ, সময় টেলিভিশনের ব্যুরোপ্রধান প্রমল কান্তি কমল দে, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক দেব দুলাল ভৌমিক ও একুশে টিভির আবাসিক প্রতিনিধি রফিকুল বাহার। ১৮ জুলাই নগরের বহদ্দারহাটে তাদের কেউ যাননি বলে দাবি করেছেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আজিজুল বলেন, ‘হৃদয় তরুয়া আমার ছোট ভাই ফজলুল হকের রুমমেট ছিলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়কারীরা যাদের নাম দিয়েছেন, তাদের আসামি করেছি। এজাহারটা যেভাবে দিয়েছিলাম সেভাবে রাখেনি পুলিশ। তাই এজাহার সংশোধনের আবেদন করেছি আদালতে। এর পরও নিরপরাধ কেউ আসামি হলে তাদের বাদ দিতে তদন্ত কর্মকর্তাকে বলা আছে।’ তাঁর বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘গত ১৭ বছর বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হয়েছি। আমার প্রতিপক্ষ লোকজন পুলিশ ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে টাকার মাধ্যমে চুক্তি (কন্ট্রাক্ট) করে আমাকে মামলা দিয়ে হয়রানি করেছে।’ এ বিষয়ে জানতে চাইলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন-চট্টগ্রামের সমন্বয়ক রাসেল আহমেদ বলেন, ‘এক ব্যক্তি মামলার কথা বলেছিলেন। তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে মামলা করতে বলেছি। অনেকেই অনেক বিষয় নিয়ে কথা বলে থাকেন। সবার তথ্য খতিয়ে দেখা সম্ভব হয় না। তবে উদ্দেশ্যমূলক মামলা হলে তা সমাধান করার দায়িত্ব প্রশাসনের।’
সাবেক জামাতার নামে একের পর এক মামলা
নগরের বাকলিয়া থানার কেবি আমান আলী রোডের মো. বখতিয়ারের ছেলে রিয়াদ ইখতিয়ার। তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সহকারী ব্যবস্থাপক। ২০২২ সালে বোয়ালখালী উপজেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুন্নবী চৌধুরীর মেয়ের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। গত ২৮ জানুয়ারি বিচ্ছেদ হয়। গত ৫ আগস্টের পর রিয়াদের বিরুদ্ধে চারটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলা করেছেন বোয়ালখালী উপজেলার পূর্ব ধোরলা গ্রামের ইউছুপ আলী। গত ৯ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে করা মামলাটিতে ৫৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। অন্য আসামি সবাই বোয়ালখালী উপজেলার হলেও একমাত্র রিয়াদ ঘটনাস্থল থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরের বাসিন্দা। অভিযোগ করা হয়, গত ৩ আগস্ট সরকার পতনের দাবিতে বোয়ালখালীতে মিছিলে আসামিরা হামলা করে। ঘটনার সময় দুপুর ১২টা। রিয়াদ যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, সেই প্রতিষ্ঠানের ডিজিটাল হাজিরা তথ্য অনুযায়ী, তিনি গত ৩ আগস্ট সকাল সাড়ে ৮টায় কর্মস্থলে প্রবেশ করেছেন। অফিস থেকে বের হয়েছেন বিকেল সাড়ে ৫টায়।
জানতে চাইলে বাদী ইউছুপ আলী এ বিষয়ে পরে কথা বলবেন বলে ফোন কেটে দেন। রিয়াদকে আসামি করে গত ১৯ সেপ্টেম্বর আদালতে আরেকটি মামলার আবেদন করেন বোয়ালখালীর শ্রীপুর ইউনিয়নের শহীদ জিয়া স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক ত্রিদীপ চৌধুরী সুফল। পরে তাঁর আবেদনটি খারিজ করে দেন আদালত। ত্রিদীপ বলেন, ‘মামলায় কাদের আসামি করা হয়েছে, আমি জানতাম না। একটি পক্ষ আমার মাথায় নুন রেখে বরই খেতে চেয়েছিল। ৬৩ জন আসামির মধ্যে ২৫ জনই আমার বন্ধুবান্ধব ও বিএনপি সমর্থক। তারা প্রতিদিনই আমার ঘরে আসে। আমার দুঃখ হয়। তাই মামলাটি আমি আর চালাইনি।’ তাঁর আবেদনটি খারিজ হলেও একই ঘটনায় দিদার আলম নামে আরেক ব্যক্তি থানায় মামলা করেছেন। তাতে আসামির তালিকা ভিন্ন রকম। এই মামলায়ও অনেক নিরীহ মানুষ আসামি হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। রিয়াদকে আসামি করে করা সব মামলার এজাহার প্রায় একই। সব মামলায় রিয়াদ ছাড়া অন্য যাদের আসামি করা হয়েছে, তারা সবাই বোয়ালখালী উপজেলার বাসিন্দা। মামলার বাদীদের একজন স্বীকার করেছেন, মামলাগুলোতে বিভিন্ন লোক বাদী হলেও আসামি কারা হবেন, তা নির্ধারণ করেন উপজেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুন্নবী চৌধুরী ও শ্রীপুর খরণদ্বীপ ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আজিজুল হক। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নুরুন্নবী বলেন, ‘প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে আমি কাউকে মামলা দিইনি। আমি কোনো মামলার বাদীও না, সাক্ষীও না। তবু যেসব মামলা হচ্ছে, সেগুলোতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল, এমন লোক আসামি হচ্ছে। বিষয়টি আমরা দেখছি।’ সাবেক জামাতাকে মামলায় জড়ানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ছেলেটা ছাত্রলীগ করত। তাই হয়তো আসামি হয়েছে। তবে বিষয়টি সেটেল হয়ে গেছে। আমার এলাকায় মামলা হয়েছে। মামলাগুলো থেকে তাকে বাদ দিতে সুপারিশ করব বলে কথা দিয়েছি।’ তবে রিয়াদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না বলে দাবি করেছেন।
মামলার আসামি কারাবন্দিও
গত ৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে ৪৯ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলার আবেদন করেন হাসিনা মমতাজ। তিনি নগরের চান্দগাঁও মোহরা ছায়েরা খাতুন কাদেরিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। মামলাটিতে ২৮ জন সাংবাদিককে আসামি করা হয়। এ মামলায় ৩৯ নম্বর আসামি কারাবন্দি শামীম আজাদ ওরফে ব্ল্যাক শামীম। তাঁকে গত ৮ জানুয়ারি সীতাকুণ্ড থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এর পর থেকে তিনি চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন। জানতে চাইলে মামলার বাদী হাসিনা মমতাজ বলেন, ‘আমি এখন আদালতে আছি। এ বিষয়ে পরে কথা বলব।’ এর আগে তিনি গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, আদালতে মামলাটি উপস্থাপনের ঠিক আগমুহূর্তেই মামলার ড্রাফটি তাঁর হাতে দেওয়া হয়েছিল। তাড়াহুড়োর মধ্যে এজাহার পড়ে দেখেননি। এতজন সাংবাদিককে আসামি করা হয়েছে– সেটিও জানতেন না।
বাদী চেনেন না কোনো আসামিকেই
গত ২১ আগস্ট নগরের চান্দগাঁও থানায় মামলা করেন মো. সেলিম। তিনি ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার জাহানপুর গ্রামের বাসিন্দা। গত ৪ আগস্ট নগরের বহদ্দারহাটে তাঁর ছেলে ফজলে রাব্বী গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন। মামলায় ২৭০ জনকে আসামি করা হয়েছে। পেশায় কৃষক মো. সেলিম বলেন, ‘গত ১৪ আগস্ট আমি চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম। আমার ভাইসহ বিএনপি নেতারা মামলা করার পরামর্শ দিয়েছেন। আমি তো কাউকে চিনি না। বিভিন্ন সূত্রে আসামিদের নাম পেয়েছি। আমি ছেলে হত্যার বিচার চাই।’
‘প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে’
এ ধরনের মামলা প্রসঙ্গে সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক), টিআইবি চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানে যারা প্রাণ দিয়েছেন, তাদের হত্যার বিচার নিশ্চিতে বস্তুনিষ্ঠ মামলা হওয়া উচিত। কিন্তু এখন মামলা হচ্ছে চাঁদাবাজির উদ্দেশ্যে। মূলত এজাহার বাণিজ্য চলছে। এসব কারণে বিচারের পথ রুদ্ধ হবে। প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে।’
- বিষয় :
- বাণিজ্য চুক্তি
- অপরাধী