ঢাকা মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫

পরতে পরতে গলদ, মাশুল গুনছে প্রাণ-প্রকৃতি

পরতে পরতে গলদ, মাশুল গুনছে প্রাণ-প্রকৃতি

কোলাজ

 তৌফিকুল ইসলাম বাবর, চট্টগ্রাম 

প্রকাশ: ১৮ নভেম্বর ২০২৪ | ০১:০১ | আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০২৪ | ১০:১৮

কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন স্থাপনের পরিকল্পনা থেকে নির্মাণ– সর্বক্ষেত্রে ছিল গলদ। রেললাইনটি চালুর পর একে একে ধরা পড়ছে সেই ত্রুটি-বিচ্যুতি। ১৮ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে মেগা প্রকল্পটির ‘গোড়ায় গলদ’-এর মাশুল গুনতে হচ্ছে প্রাণ-প্রকৃতিকে। রেললাইনটি চালুর এক বছর পার হওয়ার আগেই ট্রেনে কাটা পড়ে প্রাণ গেছে অন্তত ১২ জনের। হাতিসহ মৃত্যু হয়েছে বিভিন্ন বন্যপ্রাণীরও। এ ছাড়া উঁচু রেললাইনে পানি আটকে বর্ষায় দেখা দিচ্ছে ভয়াবহ বন্যা।

লাইনটির নানা ত্রুটি নিয়ে গত ১৭ অক্টোবর রেলওয়েকে চিঠি দিয়েছে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ বিভাগ। এতে বলা হয়, ২০১৯ সালের প্রজ্ঞাপন অনুসারে বন্যপ্রাণীর চলাচলে আন্তর্জাতিক মানের ওভারপাস ও আন্ডারপাস নির্মাণ করতে হবে। রেললাইনটিতে সাউন্ড ব্যারিয়ার নির্মাণের কথা থাকলেও তা করা হয়নি। বনাঞ্চলে হাতির চলাচল নির্বিঘ্ন করতে তিনটি আন্ডারপাসের মধ্যে নির্মাণ হয়েছে মাত্র একটি; তাও সরু। এ ছাড়া উচ্চতা এত কম, দেখলে মনে হয় কালভার্ট। এতে বন্যপ্রাণীর স্বাভাবিক চলাচল ও বসবাস ব্যাহত হচ্ছে। আবার বনাঞ্চল দিয়ে ট্রেন চলাচলে গতিসীমা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিও মানা হচ্ছে না।

এদিকে রেলের সবচেয়ে সুন্দর ও আকর্ষণীয় স্টেশন এই কক্সবাজারেই। বৃষ্টি হলে ঝিনুক আকৃতির স্টেশনটির ছাদ থেকে এখনই চুইয়ে পড়ে পানি। ড্রেন উপচে প্লাবিত হয় প্ল্যাটফর্ম। অথচ স্টেশনটি নির্মাণে খরচ হয়েছে ২১৫ কোটি টাকা।

দেশের সর্ববৃহৎ পর্যটনকেন্দ্র কক্সবাজার পর্যন্ত রেল যোগাযোগ স্থাপনের দাবি অনেক বছরের। চট্টগ্রামের দোহাজারী পর্যন্ত রেললাইনও ছিল। পরে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০১ কিলোমিটার রেললাইন স্থাপন করা হয়। ২০২৩ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে এ রুটে বাণিজ্যিকভাবে ট্রেন চলাচল শুরু হয়। এখন চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের পাশাপাশি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে চার জোড়া ট্রেন চলাচল করে এই রুটে। একের পর এক ত্রুটির বিষয় সামনে আসায় গত ৫ ও ৬ নভেম্বর রেললাইন এবং আইকনিক স্টেশন পরিদর্শনে যান রেল পরিদর্শন অধিদপ্তরের (জিআইবিআর) প্রধান পরিদর্শক প্রকৌশলী ফরিদ আহমেদ। তিনি জানান, লেভেল ক্রসিং, পয়েন্ট ক্রসিং, নিরাপত্তা, ট্র্যাক, সিগন্যালিং সিস্টেম, ইলেকট্রিক্যাল সিস্টেমগুলো দেখেছেন। বন্যার পানিতে যেসব স্থানে রেললাইন ডুবে যায়, তাও দেখেছেন। এ বছর বন্যায় রেললাইনটি ডুবে যাওয়ার পর নতুন চারটি কালভার্ট তৈরি করা হয়েছে। লোহাগাড়ার চুনতি থেকে হারবাং অভয়ারণ্যে পাহাড় ধসে রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়ও নজরে এনেছেন। এসব বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে মন্ত্রণালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দেবেন তিনি।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী সমকালকে বলেন, ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলের সবচেয়ে লাভজনক রুট। এই রুটে প্রচুর যাত্রী। কিন্তু বিভিন্ন ত্রুটির কারণে রেললাইনটি অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। মানুষের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রাণীর মৃত্যু হচ্ছে। বর্ষায় দেখা দিচ্ছে ভয়াবহ বন্যা। পরিকল্পনায় গলদের কারণে এমন মাশুল গুনতে হচ্ছে। বিষয়গুলো আমলে নিয়ে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে।

বন্যপ্রাণীর মরণফাঁদ

দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইনের প্রায় ২২ কিলোমিটার পড়েছে বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্যে। এদিক দিয়ে রেললাইন নির্মাণ করার শুরুতেই আপত্তি জানিয়েছিল বন বিভাগ। তবে পাত্তা দেয়নি রেলওয়ে। কথা ছিল, রেলওয়ে পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো নির্মাণের পাশাপাশি হাতি চলাচলে তিনটি ওভারপাস ও আন্ডারপাস নির্মাণ করবে। কিন্তু করা হয়েছে একটি আন্ডারপাস। সেটিও সরু ও কম উচ্চতার হওয়ায় হাতির পাল চলতে পারে না। ফলে রেললাইনে উঠে আসছে হাতি। এতে গত ১৩ অক্টোবর ট্রেনের ধাক্কায় একটি হাতির মৃত্যু হয়। 

প্রাণীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন পিপল ফর এনিম্যাল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান স্থপতি রাকিবুল হক এমিল বলেন, বন্যপ্রাণীর জন্য নিরাপদ করতে যেসব শর্ত মেনে রেললাইনটি নির্মাণের কথা ছিল, রেলওয়ে তা করেনি। স্বাভাবিকভাবেই এই রেললাইন বন্যপ্রাণীর জন্য বিপদের কারণ হয়ে উঠেছে। বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ বিভাগও পড়েছে বিপদে। সংস্থাটির চট্টগ্রাম বিভাগীয় কর্মকর্তা আবু নাছের মোহাম্মদ ইয়াছিন বলেন, বনাঞ্চলে রেললাইন স্থাপনে বেশ কিছু নিয়ম-কানুন মানার কথা ছিল রেলওয়ের। তারা তা না করায় বন্যপ্রাণীর জন্য স্বাভাবিক জীবন ও বিচরণে সমস্যা হচ্ছে। 

দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর সারি

বিভিন্ন রেলক্রসিংয়ে প্রয়োজনীয় লাইনম্যান না থাকা এবং অসচেতনতায় প্রাণ হারাচ্ছেন মানুষ। গত মে থেকে এই রুটে ট্রেন দুর্ঘটনায় ১২ জনের প্রাণহানি ঘটেছে।

স্থানীয়রা জানান, দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত অনেক স্থানে ছোট ছোট রেলক্রসিং আছে। সেখানে নেই প্রয়োজনীয় লাইনম্যান। এ ছাড়া অসচেতন মানুষ যখন তখন গরু-ছাগল, ট্রাক্টর, পিকআপ, মোটরসাইকেল নিয়ে রেলপথ পার হতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ছেন।

সর্বশেষ গত ৩ অক্টোবর চকরিয়া উপজেলার পূর্ব ভেওলা এলাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়। ৭ নভেম্বর মোটরসাইকেলে রেললাইন পার হওয়ার সময় রামুতে ট্রেনের ধাক্কায় প্রাণ যায় দুই যুবকের। এ ছাড়া মে মাসে সাতকানিয়ায় একজন ও ঈদগাঁওয়ে এক কৃষক, জুনে পটিয়ায় এক নারী, জুলাইয়ে বোয়ালখালী-পটিয়ার কাছাকাছি স্থানে একজন ও রামুতে একজন, আগস্টে পটিয়া স্টেশনের কাছে এক ব্যক্তি, সেপ্টেম্বরে চকরিয়ায় এক যুবক এবং অক্টোবরে একজন ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। 

বর্ষায় পানিপ্রবাহে বাধা, ডুবছে দক্ষিণ চট্টগ্রাম

নতুন আরেক বিপদ তৈরি করেছে এই রেললাইন। দোহাজারী-সাতকানিয়া-লোহাগাড়া-চুনতি-হারবাং-ডুলাহাজারা-চকরিয়া-রামু হয়ে যাওয়া এ রেলপথের দু’পাশে পানিপ্রবাহ ঠিক রাখতে তৈরি করা হয়নি পর্যাপ্ত কালভার্ট। এতে গত বর্ষা মৌসুমে পানি এক পাশ থেকে আরেক পাশে সরতে না পেরে দেখা দেয় ভয়াবহ বন্যা। ডুবে যায় অনেক ঘরবাড়ি। দাবির মুখে পরে চারটি কালভার্ট নির্মাণ করা হলেও তা পর্যাপ্ত নয় বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। এ ছাড়া পাহাড়ি এলাকায় শক্তিশালী ও উঁচু রিটার্নিং ওয়াল নির্মাণ না করায় পাহাড় ধসে রেললাইন ধসার পাশাপাশি তা বেঁকেও যায়। 

হাজার হাজার কোটির রেললাইনে ট্রেন মাত্র তিন জোড়া

১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ রেললাইনে অন্তত ২৩ জোড়া (যাওয়া-আসা মিলে) ট্রেন চলাচলের কথা ছিল। এখন পর্যন্ত চলছে মাত্র তিন জোড়া। এর মধ্যে দুই জোড়া ট্রেন চলাচল করছে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার। আরেক জোড়া ট্রেন চলাচল করছে চট্টগ্রাম থেকে। 

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক নাজমুল ইসলাম জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলের অন্যতম লাভজনক রুট। কিন্তু কোচ, ইঞ্জিন ও লোকবল সংকটে এ রুটে ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানো যাচ্ছে না। তবে রেলওয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে, যেন যাত্রী চাহিদা বিবেচনায় ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানো যায়। 

আরও পড়ুন

×