ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

বনের জমিতে কাঠের হাট

বনের জমিতে কাঠের হাট

ঘাটাইল উপজেলার মাকড়াই এলাকায় বনের জমিতে কাঠের হাট। ছবি: সমকাল

মাসুম মিয়া, ঘাটাইল (টাঙ্গাইল) 

প্রকাশ: ২১ নভেম্বর ২০২৪ | ০৩:৫৩

ছোট হয়ে আসছে বন। দখল হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বনের এমনই এক জমি দখলে নিয়ে বসিয়েছেন কাঠের হাট। বন ঘেঁষে এই হাটে বৈধতা পায় অবৈধ কাঠ। বৈধতা দিতে স্থাপন করা হয়েছে অবৈধ স’মিল। 

এক সময় শিশু-কিশোরদের খেলার মাঠ ছিল এটি। এখন আর এখানে বল গড়ায় না। গড়ায় কাঠের গুঁড়ি। বন কর্মকর্তাদের চলাচল মাঠের পাশ দিয়েই। তবু যেন তাদের চোখে পড়ে না এসব। 

স্থানীয়রা খেলার মাঠটি উদ্ধারে কর্তৃপক্ষের কাছে কয়েক দফা আবেদন করলেও অদৃশ্য কারণে তা আর আলোর মুখ দেখেনি। মাঠটির অবস্থান ঘাটাইল উপজেলার মাকড়াই এলাকায়।

বনের ঝড়কা বিট অফিসের আওতায় মাকড়াই কুমারপাড়া মৌজা। এ মৌজায় দুই দাগ এবং দুই খতিয়ানে জমির পরিমাণ ৫৯ দশমিক ৬ একর। যার অধিকাংশ জমিই বন বিভাগের। দখল করে কাঠের হাট বসানো জমিও এই দাগ-খতিয়ানের আওতায়। 

হাটের অবস্থান ঘাটাইল-সাগরদিঘী সড়কের মাকড়াই বাসস্ট্যান্ড-সংলগ্ন। বনের এই জমি দখলে রেখেছেন প্রভাবশালীরা। তারা নিজের জমির মতোই কাঠ ব্যবসায়ীদের কাছে ইজারা দিয়েছেন। করেছেন বিক্রিও। একটা সময় পতিত এই জমিতে কুমারপাড়া, মাকড়াইসহ আশপাশের গ্রামের শিশুসহ উঠতি বয়সের ছেলেরা খেলাধুলায় মত্ত থাকত। ১৯৯১ সালে ঘাটাইলে শুরু হয় সামাজিক বনায়ন। সে সময় বনায়নের জন্য এই জমিতে গর্ত করলে প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে এলাকার মানুষ। 

প্রতিবাদ করে কাজ না হলে এলাকাবাসী ছুটে যান তৎকালীন সংসদ সদস্য লুৎফর রহমান খান আজাদের কাছে। বিষয়টি উপলব্ধি করে সরেজমিন যান আজাদ। বন বিভাগকে বুঝিয়ে খেলার মাঠটি উন্মুক্ত ঘোষণা করেন। কিন্তু এখন আর মাঠে বল গড়ায় না। গড়ায় বনের কাঠের গুঁড়ি।

মাকড়াই গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আমজাদ হোসেন বলেন, ‘আমরা ওইসময় বন বিভাগকে অনুরোধ করেছিলাম এই জমিতে গাছ না লাগাতে। পরে তারা গাছ লাগানো থেকে বিরত থাকেন। এখন আবার মানুষের দখলে চলে গেছে।’

স্থানীয়রা জানান, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে প্রভাবশালীরা ধীরে ধীরে দখলে নেন পুরো জমি। সড়কের পশ্চিম অংশের প্রায় সাড়ে তিন একর জমি হাজী আফসার ওরফে আছর আলীর দখলে। তিনি এই জমি ভাড়া দেন কাঠ ব্যবসায়ীর কাছে। ছোট এক ট্রাক কাঠ রাখলে দিনে ৩০০ টাকা দিতে হয় তাঁকে। বনের এই জমি বিক্রিও করা হয়। 

আছর আলীর বোন এই জমির ওয়ারিশ পেয়েছিলেন। সেই ওয়ারিশের চার শতাংশ কিনে নিয়েছেন আজমত আলী নামে একজন। আজমত বলেন, এই জমি খাস। জমির কোনো রেজিস্ট্রি দলিল হয় না। হস্তান্তর দলিল করে নেওয়া হয়েছে। 

আছর আলীর ভাগিনা ইউসুফ আলীর থেকে ২০২২ সালে ১১ শতাংশ জমি ৬২ এর আরওআর মূলে কিনেছেন মো. মামুন। তাঁর ভাষ্য, আরওআর মূলে যেভাবে দলিল করা হয় সেভাবেই হয়েছে। আফসার আলী বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। জমি এখন দেখভাল করেন তার ছেলে ইয়ার মাহমুদ। দখলের বিষয়ে তিনি বলেন, তারা ভোগদখল করে খাচ্ছেন প্রায় ১০ বিঘা।

মতিয়ার রহমান খান ও সুজাত আলী খান সহোদর। স্থানীয়রা জানান, তাদের দখলে রয়েছে সড়কের পূর্বাংশে প্রায় এক একর জমি। এই জমি বছর হিসেবে ভাড়া দেওয়া হয়। এ বিষয়ে মতিয়ার রহমান খানের দাবি, আরওআর মূলে ওই জমির মালিক তারা। বছরে বিঘা প্রতি ভাড়া দেন ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা।

জমি ভাড়া নিয়ে পশ্চিম অংশে স’মিল স্থাপন করেছেন কাঠ ব্যবসায়ী বাবর আলী। তিনি বলেন, তার স’মিল এখন বন্ধ। তাঁর ভাষ্য, অনেক কাঠ ব্যবসায়ী জমি ভাড়া নিয়ে এখানে ব্যবসা করছেন। পূর্বাংশে স’মিল স্থাপন করেছেন কাঠ ব্যবসায়ী শাহজাহান সাজু। তিনি বলেন, ‘আমি স’মিল বিক্রি করে দিয়েছি রতন খানের কাছে।’ কোনো বৈধ কাগজপত্র আছে কিনা? তাঁর সোজাসাপটা উত্তর– মাকড়াই এলাকায় যত স’মিল আছে কোনোটারই কাগজপত্র নেই। 

সরেজমিনে দেখা যায়, কাঠের হাটকে কেন্দ্র করে ওই এলাকায় আরও দুটি স’মিল গড়ে উঠেছে। স’মিল দুটির মালিক শাহাদৎ হোসেন ও দুলাল হোসেন। হাটটি পরিচিত কাঠখোলা হিসেবে। বন ঘেঁষে হওয়ায় লাকড়িসহ বনের সব ধরনের কাঠ মেলে এখানে। অবৈধ স’মিল থাকায় নিষিদ্ধ কাঠও চিরাইর পর হয়ে যায় বিশুদ্ধ। স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রাকৃতিক বন থেকে শাল-গজারি বিলুপ্তির জন্য নাকি এই হাট অনেকটাই দায়ী।

ধলাপাড়া রেঞ্জ কর্মকর্তা ওয়াদুদুর রহমান বলেন, বন ঘেঁষে কাঠের হাট থাকতে পারে না। চোরাই কাঠ বিক্রির তো প্রশ্নই ওঠে না। জমি দখলের বিষয়ে তিনি জানান, যারা জমিটি দখলে রেখেছেন তাদের নাকি রেকর্ড আছে। তাহলে কী মূলে বন বিভাগ ওই জমিতে ১৯৯১ সালে বনায়ন শুরু করেছিল? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই।

আরও পড়ুন

×