ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

ঋণের কিস্তি ও সংসার চালানো নিয়ে দুশ্চিন্তা

ঋণের কিস্তি ও সংসার চালানো নিয়ে দুশ্চিন্তা

আনিসুরের লাশ আসার সংবাদে কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজনরা। রোববার রাজশাহীর বাঘা উপজেলার তুলশীপুর গ্রামে সমকাল

বাঘা (রাজশাহী) প্রতিনিধি

প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০২৪ | ২৩:১৫

সহজ-সরল মানুষ ছিলেন আনিসুর রহমান। বাকপ্রতিবন্ধী এই ব্যক্তি দিনমজুরির আয়ে পাঁচ সদস্যের সংসার খরচ চালাতেন। কয়েকটি এনজিও থেকে নেওয়া ঋণের টাকায় আধাপাকা ঘর তৈরি করেছিলেন। ধীরে ধীরে ঋণের কিস্তিও শোধ করছিলেন। সব মিলিয়ে সংসার চালাতে কষ্ট হচ্ছিল। শুক্রবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান ভায়রা ভাইয়ের কাছ থেকে টাকা ধার করতে। সেখান থেকে ফেরার পর নিখোঁজ হন তিনি। পরদিন পাশের গ্রামের একটি আমবাগানে গলাকাটা লাশ পাওয়া যায় আনিসুরের।
আনিসুর রহমানের (৪২) বাড়ি রাজশাহীর বাঘা উপজেলায়। মনিগ্রাম ইউনিয়নের তুলশীপুর গ্রামের মৃত শামসুল মোল্লার ছেলে তিনি। গতকাল রোববার বাড়িতে স্বজনদের বুক চাপড়িয়ে কান্না করতে দেখা যায়। তাদের মূল কথা, প্রতি মাসে বিপুল অঙ্কের টাকা কিস্তি শোধ ও সংসার খরচ কীভাবে চালাবেন আনিসুরের স্ত্রী পারভীন বেগম।
আনিসুর-পারভীন দম্পতির তিন সন্তান। বড় মেয়ে আল্পনার বিয়ে হয়েছিল। স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর বাবার বাড়িতেই আছেন। ছোট মেয়ে মদিনার বয়স সবে সাত। সবার ছোট সোহাগ। তার বয়স মাত্র এক বছর। বড় দুই সন্তান বাবা হারানোর যন্ত্রণা টের পেলেও কিছু বোঝার বয়সই হয়নি সোহাগের। বাড়িভর্তি লোকজন দেখে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। আনিসুরের মা সত্তরোর্ধ্ব আনজেরা থেমে থেমে কাঁদছেন।
পারভীন বেগমের ভাষ্য, সংসার চালাতে তাদের কষ্ট হচ্ছে। তাঁর বোন সাথী বেগমের স্বামী রায়হান আলীর কাছ থেকে টাকা ধার নেওয়ার জন্য শুক্রবার বিকেলে বাড়ি থেকে বের হন স্বামী আনিসুর। সেখান থেকে যান মনিগ্রাম বাজারে। পরে আর ফেরেননি। শনিবার সকালে মনিগ্রামের একটি আমবাগান স্বামীর গলাকাটা লাশ পড়ে থাকার সংবাদ পান তারা।
কান্নায় ভেঙে পড়ে পারভীন বলেন, সংসার দেখাশোনার আর কেউ রইল না। ছেলেমেয়ের দেখভাল কে করবে? কেইবা জোগাবে ঋণের 
কিস্তির টাকা?
পারিবারিক সূত্র জানায়, আনিসুর আশা এনজিও থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। মাসে পাঁচ হাজার টাকা কিস্তি ও এক হাজার টাকা ডিপিএস জমা দিতে হয়। মোট ১১ কিস্তিতে ঋণ শোধ করার কথা। মাত্র একটি কিস্তি শোধ করা হয়েছে। এ ছাড়া আইডিএফের কাছে তাঁর ঋণ ৫০ হাজার টাকা। সপ্তাহে ১ হাজার ৩০০ টাকা কিস্তি দিতে হয়। ৪৬ কিস্তির মধ্যে দুটি শোধ করা হয়েছে। এ ছাড়া দিশা থেকে ঋণ নিয়েছেন ৬০ হাজার টাকা। ১ হাজার ৬০০ টাকা সাপ্তাহিক কিস্তি। ৪৬ কিস্তির মধ্যে ৩০ কিস্তি শোধ করেছেন। টিএমএসএস থেকে ৭০ হাজার টাকা ঋণ করেন আনিসুর। মাসে দেওয়া লাগে ৭ হাজার টাকা। ১১ কিস্তির মধ্যে সাতটি বাকি।
এর বাইরেও দুই মাস আগে ব্যুরো বাংলাদেশ থেকে ৬ মাস মেয়াদে আনিসুর ৫০ হাজার টাকা ঋণ নেন বলে জানান পারভীন। এই ঋণ একবারেই শোধ করতে হবে। পারভীন বলেন, ব্র্যাক বাংলাদেশ থেকে মাসিক ৪ হাজার টাকা কিস্তিতে তারা ঋণ করেছেন ৪০ হাজার টাকা। ১১টি কিস্তির মধ্যে ৭-৮ কিস্তি দিয়েছেন। ডাক নামের আরেকটি এনজিও থেকে মাসিক ৯ হাজার টাকা কিস্তিতে তাদের ঋণ ৯০ হাজার টাকা। এর মধ্যে শোধ হয়েছে ৯ কিস্তি। এসব ঋণের মধ্যে চারটির টাকা আনিসুর দিয়েছেন তাঁর ভায়রা রায়হান আলীকে।
এ বিষয়ে কথা হয় আনিসুরের ছোট ভাই আনারুল ইসলাম ও চাচাতো ভাই কবি হাফিজুর রহমানের সঙ্গে। তারা বলেন, আনিসুর বাকপ্রতিবন্ধী হিসেবে ভাতা পেতেন। শুক্রবার রাত ১০টায়ও যখন তিনি বাড়ি ফেরেননি, তখন বিভিন্ন জায়গায় খোঁজখবর নিতে থাকেন। শনিবার সকাল ৮টার দিকে জানতে পারেন, মনিগ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক বজলু রহমানের আমবাগানে লাশ পড়ে আছে। আত্মীয়স্বজন সেখানে গিয়ে শরীরের পোশাক দেখে তাঁকে শনাক্ত করেন। পুলিশ লাশ উদ্ধার করে মর্গে পাঠায়। তারা জানতে পারেন, মনিগ্রাম বাজারের ছাগলের হাট থেকে আনিসুর তাঁর ভায়রা রায়হান আলীর কাছে ৫ হাজার টাকা ধার করেন।
যদিও পারভীনের করা হত্যা মামলায় রায়হান আলীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তিনি গ্রেপ্তারের আগে জানিয়েছিলেন, তাঁর কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা নিয়ে সন্ধ্যার পরই আনিসুর বাড়ির উদ্দেশে রওনা হন।
চারঘাট-বাঘা সড়কের পূর্বদিকে আনিসুরের বাড়ি। পথেই চায়ের দোকান রয়েছে বজলু মিয়ার। তিনি রোববার বলেন, বাড়ি ফেরার পথে মাঝেমধ্যেই এখানে বসতেন আনিসুর। শুক্রবার রাত ৮টার দিকেও এসেছিলেন। কিছুক্ষণ পরই চলে যান।
এলাকাবাসীর কাছে আনিসুরের পরিচিতি সরল-সহজ মানুষ হিসেবে। কেউ ভালো করে কথা বললেই তাঁর সঙ্গেই চলে যেতেন। কোনোরকম নেশায় আসক্ত ছিলেন না। হত্যাকাণ্ডটি নিয়ে তাই স্পষ্ট কোনো ধারণা করতে পারছেন না তারা। গ্রেপ্তার আনিসুরের ভায়রা রায়হান আলীকেও নির্দোষ দাবি করেছেন তাঁর স্ত্রী সাথী বেগম।
পারভীনের করা মামলা তদন্ত করছেন বাঘা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) বজলুর রশিদ। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে আনিসুরের ভায়রা রায়হান আলীকে গ্রেপ্তার করেছেন। লাশ ময়নাতদন্তের জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়। প্রতিবেদন পাওয়ার আগে কিছু বলা কঠিন। 
এদিকে লাশের ময়নাতদন্ত শেষে রোববার দুপুর ৩টার দিকে তুলশীপুরের বাড়িতে আনা হয় আনিসুরের লাশ। আসরের নামাজের পর স্থানীয় মসজিদ মাঠে জানাজা শেষে বিকেল ৪টায় পারিবারিক কবরস্থানে তাঁর লাশ দাফন সম্পন্ন হয়।
 

আরও পড়ুন

×