ফের ভূমিখেকোদের কবলে সুনামগঞ্জের সাত খাল

ছবি: সংগৃহীত
সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৮ নভেম্বর ২০২৪ | ০৩:০৩
সুনামগঞ্জ শহরে কামালখাল, বলাইখাল, তেঘরিয়া খাল, বড়পাড়া খাল ও নলুয়াখালি খাল– এই পাঁচটি খাল ছাড়াও একসময় ধোপাখালি খাল ও গাবরখালি খাল নামে আরও দুটি বড় খালের অস্তিত্ব ছিল, যা এখন বেদখল। এ খালগুলো ছিল সুরমা নদী ও শহরের পার্শ্ববর্তী হাওরের সঙ্গে সংযুক্ত।
ফলে শহরের পানি নিষ্কাশনের প্রধান উৎস ছিল এ খালগুলো। সে জন্য অতীতে টানা বৃষ্টিপাত হলেও শহরে কখনও জলাবদ্ধতা তৈরি হতো না। এখন শহর সম্প্রসারণ হয়েছে; গড়ে উঠছে নতুন আবাসিক এলাকা। ফলে ওই খালগুলোর প্রয়োজনীয়তা আরও বেড়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলো, শহর সম্প্রসারণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে একের পর এক খাল দখল হয়ে গেছে। অবৈধভাবে খালের জমি দখল করে গড়ে উঠেছে পৌরসভা পরিচালিত স্কুল, কমিউনিটি সেন্টার, এমনকি সরকারি স্কুল, মসজিদ-মাদ্রাসাও।
আদালতের নির্দেশে গত বছরের জুলাইয়ে সুনামগঞ্জ শহরের সাতটি খালের বেশির ভাগ অংশ স্থানীয় প্রশাসন একবার দখলদারদের কবল থেকে উদ্ধার করেছিল। কিন্তু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশে অস্থিরতার সুযোগে খালগুলোর দিকে আবার চোখ পড়েছে দখলদারদের। ফের একটু একটু করে দখল হতে শুরু করেছে খালের আশপাশের জমি।
স্থানীয় প্রশাসন বলছে, অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ায় খালগুলো নতুনভাবে খনন করে সেগুলোতে প্রাণ ফেরানো যাচ্ছে না। দ্রুত খালগুলো জীবন্ত না করলে ভূমিখেকোরা আবার এর পাড়ে নতুন স্থাপনা নির্মাণ করে দখলে নেবে। গত মঙ্গলবার শহরের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষজন সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে খালগুলোর প্রবাহে প্রাণ ফেরানোর উদ্যোগ না নেওয়ায় সংশ্লিষ্টদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি অবিলম্বে খাল উদ্ধার এবং প্রবাহ সচল করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে পৌর কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন।
মতবিনিময় সভায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ও সুনামগঞ্জ পৌরসভার প্রশাসক সমর কুমার পাল বলেন, ১ দশমিক ৮০০ কিলোমিটার, অর্থাৎ ১ হাজার ৮০০ মিটার দৈর্ঘ্যের কামালখালের একদিকে দেখার হাওর অন্যদিকে সুরমা নদী। দেখার হাওরের অংশ নতুনপাড়া থেকে উৎপত্তি হয়ে তেঘরিয়া মৌজার আরপিননগরে সুরমা নদীতে পতিত হয়েছে। গত ১৫ ও ১৬ নভেম্বর কামারখালে জরিপ কাজ সম্পন্ন করা হয়। এ সময় দেখা যায়, ০.০০ কিলোমিটার থেকে ০.০৫১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য পর্যন্ত খালটির পতিত স্থান ভরাট করে উত্তর আরপিননগর পৌর প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন, একটি কমিউনিটি সেন্টার এবং রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। পাকা স্থাপনা খালের পতিত স্থান বরাবর নির্মাণ করার কারণে খালের মুখ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। সুরমা নদীর মুখে যেখানে কামারখাল পতিত হয়েছে সেখানে ৫৯ মিটার খালের প্রবাহের যেন টুঁটি চেপে ধরা হয়েছে। এ ছাড়া তিনি কামারখালের নানা দুর্দশার চিত্র তুলে ধরেন। এ সময় উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান জানতে চান, নির্মিত স্থাপনাগুলো কার মালিকানাধীন। পৌরসভা স্বয়ং খালের মুখ বন্ধ করে স্থাপনা নির্মাণ করেছে জেনে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন।
কামারখালসহ অন্য খালগুলোতে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, পুনর্খনন ও পুনর্বাসন কাজে সম্ভাব্য ১০৫ কোটি টাকা ব্যয় হতে পারে উল্লেখ করে পৌর প্রশাসক বললেন, তাৎক্ষণিকভাবে পয়ঃনিষ্কাশন সুবিধার জন্য ড্রেনে জমাকৃত পলি ও ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করার ব্যবস্থা পাউবো কর্তৃক গ্রহণ করা যেতে পারে। দ্রুত অর্থসংস্থান হলে ছয় মাসের মধ্যে আমরা কাজ করতে পারব।
জবাবে উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, এটা খুবই দুঃখের বিষয়, পৌরসভা ড্রেন করল, অসংখ্য মানুষ বাড়ি করল কীভাবে? কামারখাল সব সময় জেলা প্রশাসনের এক নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত ছিল। উপস্থিত সুধীজনের কাছে তিনি জানতে চান, এ বিষয়ে জেলা প্রশাসনের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলায় মামলা আনা যায় কিনা?
১০৫ কোটি টাকা পাউবো কী উপলক্ষে দেবে জানতে পারলে ভালো হতো প্রশ্ন রেখে উপদেষ্টা বলেন, তারা কেন এটা করবে। পাউবোর ওপর পুরোটা দায় চাপানোর যুক্তিটা কী? এটা পাউবোর খাল নয়। এটা রক্ষণাবেক্ষণ করার কথা ডিসি মহোদয়ের। তিনি করেননি কেন? কেন এতগুলো ভবন এখানে হয়ে গেল? এতগুলো ভবনের তালিকা কী? কামারখাল দখলমুক্ত করতে হবে উল্লেখ করে রিজওয়ানা হাসান জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়াকে পৌরসভার সঙ্গে বসে কথা বলার নির্দেশনা দেন। পৌরসভা কেন খালের ওপর ড্রেন করল, তাদের ড্রেন সরাতে বলার জন্য তিনি জেলা প্রশাসককে কথা বলতে বলেন।
উপদেষ্টা বলেন, পৌরসভাকে নিজেদের অবৈধ স্থাপনা সরাতে হবে, এটা সরানোর দায়িত্ব আমার নয়। পাউবো এক্সক্যাভেটর, বুলডোজার দিয়ে বা অন্যান্যভাবে সাপোর্ট করে আপনাদের সহায়তা করতে পারে। এলাকার মানুষ ড্রেন হওয়ার আগেও চলাচল করেছেন। খালের ওপর দিয়ে মানুষের চলাচলে প্রয়োজনে সেতু করে দেওয়া যেতে পারে।