সংরক্ষিত বাঙ্কার এলাকায় চোখ পাথর লুটেরাদের

সিলেটের ভোলাগঞ্জের সংরক্ষিত বাঙ্কার এলাকা থেকে প্রতিদিন এভাবে প্রকাশ্যে পাথর লুট করে প্রভাবশালীরা সমকাল
মুকিত রহমানী, সিলেট
প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২২:৩৮
সংরক্ষিত এলাকার মাটি খুঁড়ে পাথর বের করে আনছে শ্রমিকরা। টুকরিভর্তি করে তা রাখা হচ্ছে নদীর তীরে। আরেক দল শ্রমিক সেখান থেকে পাথর তুলছে ছোট ছোট বারকি ও ইঞ্জিনচালিত নৌকায়। এর পর নদীপথে তা বিভিন্ন এলাকায় নেওয়া হচ্ছে। সরেজমিন পাথর লুটপাটের এমন দৃশ্য দেখা যায় বন্ধ থাকা সিলেটের ভোলাগঞ্জে পাথর পরিবহনে নির্মাণ করা রোপওয়ে স্টেশন এলাকায়। স্থানীয়ভাবে বাঙ্কার নামে পরিচিত ওই এলাকার পাশেই ছিল বিজিবির টহল নৌকা। তবে তাদের কোনো ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি।
ভারতের খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড়ের পাদদেশে ভোলাগঞ্জ সীমান্তে ধলাই নদীর উৎসমুখে রয়েছে বাংলাদেশের প্রধান পাথর কোয়ারি। ধলাই নদীতে পাথরের বিশাল মজুদের কথা চিন্তা করে ১৯৬৪-৬৯ সালে এই কোয়ারির কাছে রেলওয়ের জমিতে নির্মাণ করা হয় ভোলাগঞ্জ-ছাতক রোপওয়ে প্রকল্প। বসানো হয় স্বয়ংক্রিয় পাথর প্লান্ট। সেখানে পাথর ভেঙে তা রোপওয়ে বা কেবল লাইনের মাধ্যমে পাঠানো হতো ১৯ কিলোমিটার দূরে সুনামগঞ্জের শিল্পনগরী ছাতকে। তবে ১০ বছর আগে এটি বন্ধ হয়ে যায়। এর পর এ প্রকল্প এলাকার সম্পদ পাহারায় ছিল রেলওয়ের নিরাপত্তা বাহিনী-আরএনবি।
গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভোলাগঞ্জজুড়ে শুরু হয় পাথর লুটপাটের মচ্ছব। ভোলাগঞ্জ প্রধান কোয়ারি, পাশের সাদাপাথর পর্যটন এলাকা এবং আলোচিত শারফিন টিলা থেকে পাথর লুটপাটের পর এবার বাঙ্কার এলাকায় চোখ পড়েছে দুর্বৃত্তদের। অন্যান্য স্থানের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলেও এখন প্রতিদিন বাঙ্কার এলাকা থেকে লুট হচ্ছে লাখ লাখ টাকার পাথর। দিন-দুপুরে কয়েকশ নৌকায় পালাক্রমে এখান থেকে সরানো হচ্ছে পাথর।
স্থানীয়রা জানান, রেলওয়ের নিরাপত্তা বাহিনী ৫ আগস্ট চলে যাওয়ার পর বাঙ্কারের নিরাপত্তার দায়িত্ব বর্তায় কার্যত স্থানীয় বিজিবির ওপর। অথচ বাঙ্কারের কাছে একটি ক্যাম্প ও দুটি পোস্ট থাকার পরও বিজিবি আছে দর্শকের ভূমিকায়।
বিষয়টি নিয়ে গত ২৫ নভেম্বর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় আলোচনাও হয়। সেখানে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ তুলে বিজিবিকে ১০ দিনের সময় দেওয়া হয়। তবে অভিযোগ উঠেছে, বিজিবি সদস্যরাই নৌকাপ্রতি ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা নিয়ে পাথর লুটের সুযোগ করে দিচ্ছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের পতনের পর পাথর লুটের নতুন সিন্ডিকেটও গড়ে উঠেছে। এরা ভোলাগঞ্জ কোয়ারি এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্রের বিশাল এলাকা পাথর ব্যবসার জন্য ভাড়া দিয়েছে। বাঙ্কার থেকে লুট করা পাথর সরাতে চাঁদাও আদায় করছে।
৫ আগস্টের পর বেশি লুটপাট
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পাথর লুটকারীরা অনেকটা হামলে পড়ে পাথররাজ্য কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ কোয়ারি এলাকায়। সাদাপাথর পর্যটন এলাকা থেকে কয়েক দিনেই লুট হয় কয়েক কোটি টাকার পাথর। ভোলাগঞ্জ স্থলবন্দরের পাশে পর্যটনকেন্দ্রের জন্য অধিগ্রহণ করা জমিতে প্রায় দেড় কোটি টাকায় নির্মাণ করা দেয়ালও ওই সময় ভেঙে ফেলা হয়। সেখানকার ইট লুটের পাশাপাশি বসানো হয় একাধিক মিনি স্টোন ক্রাশার মেশিন। হামলা হয় বাঙ্কার এলাকায়ও। খুলে নেওয়া হয় লোহা, তামা ও টিন। ভাঙচুর করা হয় স্থানীয় বিজিবি ক্যাম্প ও পোস্ট।
গত ২৫ নভেম্বর সরেজমিন দেখা যায়, বাঙ্কার এলাকার পাশাপাশি নদী থেকে এখনও বিচ্ছিন্নভাবে অনেকে বালু ও চিপ পাথর উত্তোলন করছে। উপজেলা শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম বলেন, আগে মিলেমিশে ব্যবসা করা হয়েছে। এখন নতুন সিন্ডিকেট প্রকাশ্যে লুটপাট ও চাঁদাবাজি করছে। প্রশাসন জেনেও ব্যবস্থা নিচ্ছে না। সংরক্ষিত বাঙ্কার এলাকাটি যেন নদীর সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা চলছে।
পর্যটন ঘাটের রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী বিলাল আহমদ জানান, প্রতিদিন শত শত নৌকা দিন-রাত পাথর লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। ৫ আগস্টের পর এটি অনেক বেড়েছে।
সিন্ডিকেটমুক্ত হচ্ছে না ভোলাগঞ্জ ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারিকে কেন্দ্র করে সব সময় সক্রিয় থাকে বিভিন্ন সিন্ডিকেট। আওয়ামী লীগের পতনের কয়েক দিনের মধ্যেই তৈরি হয়েছে নতুন সিন্ডিকেট। স্থানীয়দের তথ্যমতে, ভোলাগঞ্জ এখন নিয়ন্ত্রণ করছেন উপজেলা বিএনপি সভাপতি হাব উদ্দিন ও যুবদলের আহ্বায়ক সাজ্জাদুর রহমান দুদুর সিন্ডিকেট। এ দলে রয়েছেন সাজ্জাদের ভাই আনোয়ার ও বোরহান, সহযোগী জাহাঙ্গীর মিয়া, জাকির হোসেন, সাজন আহমদ, মজফরসহ কয়েকজন। এ ছাড়া পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মাহফুজ মিয়া, সাধারণ সম্পাদক কবির আহমদ, যুবদল নেতা বাহার আহমদ রুহেলসহ আরেকটি বলয়ও সক্রিয়।
৫ আগস্টের পর ভোলাগঞ্জ স্থলবন্দরের পাশে ট্যুরিজম বোর্ডের অধিগ্রহণ করা জমির দেয়াল ভেঙে দখলে নেয় এসব সিন্ডিকেট। সরেজমিন দেখা যায়, ওই স্থানে ২৫-২৬টি মিনি ক্রাশার মেশিন বসিয়ে পাথর ভাঙা হচ্ছে। শ্রমিকরা জানান, শতক হিসেবে ওই জায়গা কারও কাছে এক বছর বা মাসের হিসাবে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বাঙ্কার এলাকা থেকে লুট করা পাথর আনলোড করতেও টাকা তুলছে সিন্ডিকেট। অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করে বিএনপি নেতা সাহাব উদ্দিন বলেন, তাঁর অধীনে কোনো জায়গা নেই। ব্যবসায়ীরা পাথর রেখেছেন।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবিদা সুলতানা বলেন, পাথর ও বালু লুট বন্ধে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। বাঙ্কার এলাকা থেকে পাথর লুটের বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, আরএনবি চলে যাওয়ায় বাঙ্কার এলাকা অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। রেল কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় বিজিবিকে সময় দেওয়া হয়েছে।
বিজিবি সদস্যদের চাঁদা আদায়ের অভিযোগ বিষয়ে জানতে সিলেট ৪৮-বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল হাফিজুর রহমানকে
একাধিকার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। স্থানীয় বিজিবির ক্যাম্প কমান্ডার এ বিষয়ে কথা বলতে চাননি।
- বিষয় :
- পাথরখনি