ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

ছোট ভাইয়ের সন্ধানে দিনরাত ঘুরছেন জবি শিক্ষার্থী তানিয়া

কমলাপুর রেলস্টেশনেই টানা ৪৮ ঘণ্টা

ছোট ভাইয়ের সন্ধানে দিনরাত ঘুরছেন জবি শিক্ষার্থী তানিয়া

ফাইল ছবি

 ইয়াসির আরাফাত

প্রকাশ: ০২ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:২২

শিশু রায়হান হোসেন রিজভীর সন্ধানে ঘুরছেন মামাতো বোন ফাতেমা তুজ জহুরা তানিয়াসহ পরিবারের সদস্যরা। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী তানিয়া টানা দুই দিন কমলাপুর রেলস্টেশনেই কাটিয়ে দিয়েছেন। ফেসবুকে নিখোঁজ হওয়ার তথ্য দেখে কেউ একজন জানান, রিজভীকে (১২) কমলাপুর স্টেশনে দেখা গেছে। এর পর ১০ থেকে ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত স্টেশনে গিয়েছেন প্রতিদিন। দুই রাত কাউন্টারের মেঝেতে শুয়ে কাটিয়েছেন; কিন্তু সন্ধান পাননি।

গত ২ নভেম্বর বিকেলে কুষ্টিয়া শহরের চৌড়হাসে সরকারি শিশু পরিবার (এতিমখানা) থেকে নিখোঁজ হয় রিজভী। বিষয়টি তার স্বজনরা জানতে পারেন দু’দিন পর। এ নিয়ে শিশু পরিবার কর্তৃপক্ষের অবহেলার অভিযোগ ওঠে। তদন্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে দুই কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত এবং এই দু’জনসহ পাঁচজনকে বদলি করা হয়।
২০১২ সালে রিজভীর জন্ম হওয়ার তিন ঘণ্টা পর মারা যান তার মা। এর তিন মাস পর বিয়ে করেন তার বাবা কুমারখালী উপজেলার কান্দাবাড়ি গ্রামের কৃষক আয়ুব আলী। তার একমাত্র ভাই কলেজ শিক্ষার্থী রাব্বি হোসেন বাবার সঙ্গেই থাকেন। রিজভীকে জন্মের পর থেকেই লালনপালন করেন শিক্ষক দম্পতি লোকমান হোসেন ও রেবেকা সুলতানা। রিজভীর মামা লোকমান কুষ্টিয়ার ইসলামিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক এবং রেবেকা সুলতানা পাংশা পাইলট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। তাদের মেয়ে তানিয়া, বড় ছেলে মেডিকেল শিক্ষার্থী। শিক্ষকতা নিয়ে দু’জনই ব্যস্ত থাকায় রিজভীকে দু’বছর আগে শিশু পরিবারে দেন বলে জানান লোকমান হোসেন।

গত ৪ নভেম্বর সন্ধ্যার পর খুলনার রেলস্টেশনে একটি ব্যাগ পেয়ে সেটিতে থাকা মোবাইল ফোন নম্বরে কল দেন সেখানকার একজন ফলের আড়তদার। রিজভীর পরিবারের সদস্যরা ফোন পেয়ে শিশু পরিবার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। প্রথমে তারা নিখোঁজের তথ্য স্বীকার করতে চাননি বলে অভিযোগ। তৃতীয়বার ফোনে কথা হলে বলা হয়, রিজভী দু’দিন ধরে নিখোঁজ। প্রতিষ্ঠানের সহকারী তত্ত্বাবধায়ক ইলিয়াস হোসেন প্রথমে ছুটিতে আছেন বললেও দ্বিতীয়বার ফোন করলে বলেন, তিনি ছুটিতে নেই।
৫ নভেম্বর কুষ্টিয়া মডেল থানায় জিডি করে শিশু পরিবার কর্তৃপক্ষ। নিখোঁজ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানানো হয়নি কেন– এ প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। শিশু পরিবারের সভাপতি জেলা প্রশাসক মো. তৌফিকুর রহমান ও সদর মডেল থানার ওসি দীপেন্দ্র নাথ সিংহসহ কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরাও সে সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন এবং তারা নিখোঁজ শিশুর সন্ধান চেয়ে বিক্ষোভ করেন। শিশু পরিবারে অবস্থানকারী শিশুরাও বিক্ষোভ করে রিজভীর সন্ধান দাবি করে। তারা সহকারী তত্ত্বাবধায়ক ইলিয়াস হোসেনের পদত্যাগ এবং শাস্তির দাবি জানায়।

এ ঘটনায় সমাজসেবা অধিদপ্তর গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে অনিয়ম-দুর্নীতি ও নির্যাতনের চিত্র উঠে আসে। পরে উপতত্ত্বাবধায়ক আসাদুজ্জামান ও সহকারী তত্ত্বাবধায়ক ইলিয়াস হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় এবং এ দু’জনসহ পাঁচ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বদলি করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে রিজভীর বোন তানিয়া বলেন, ‘নিখোঁজের ঘটনায় জড়িতদের বদলি করলেই সমাধান হয়ে যায় না, এটি কোনো শাস্তি নয়।’ 
তানিয়া এক ব্যক্তির মেসেঞ্জারে দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে একবার টঙ্গী স্টেশনে যান, সেখানে বহু মানুষকে ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেন এবং পোস্টার লাগিয়ে রেখে আসেন। উত্তরা থেকেও একবার তথ্য আসে রিজভীকে দেখা গেছে। সেখানে ছুটে যান তানিয়া। কিন্তু দিনভর খুঁজেও তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। 
এদিকে রাজশাহী থেকে ট্রেনে করে প্রতিটি স্টেশনে নেমে রিজভীর ছবি দেখিয়ে লোকজনকে তার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেন লোকমান হোসেন। কিন্তু হদিস মেলেনি।

তানিয়া বলেন, ‘এত এত জায়গায় যাচ্ছি, খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারি পর্যায় থেকে তেমন সহযোগিতাও পাচ্ছি না। রিজভী অনেক আগ থেকেই প্রতিবাদী ছিল। এ কারণে শিশু পরিবার কর্তৃপক্ষ তার ওপর রেগে ছিল। আসলে কী হলো তা জানার উপায় নেই, কারণ সন্দেহভাজনদের বদলি করে দেওয়া হয়েছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কুষ্টিয়া শিশু পরিবারের তত্ত্বাবধায়ক আফসার আলী সমকালকে বলেন, ‘শিশুটির খোঁজ চলছে। থানা থেকে কয়দিন আগেও লোক এসেছিল। আমরা নানাভাবে চেষ্টা করছি; কিন্তু কোনো কূলকিনারা করতে পারছি না।’
কুষ্টিয়া মডেল থানার এসআই খায়রুজ্জামান সমকালকে বলেন, ‘দেশের সব থানায় ছবিসহ বার্তা পাঠিয়েছি। যেখান থেকেই খবর এসেছে, পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে সন্ধানের চেষ্টা চালিয়েছি।’
 

আরও পড়ুন

×