ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি

ভূমিসহ মৌলিক বিষয়ে অগ্রগতি নেই ২৭ বছরেও

ভূমিসহ মৌলিক বিষয়ে অগ্রগতি নেই ২৭ বছরেও

ফাইল ছবি

 সমকাল প্রতিবেদক ও রাঙামাটি প্রতিনিধি 

প্রকাশ: ০২ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:৩৯

‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি ২৭ বছর আগে স্বাক্ষরিত হলেও এখনও বাস্তবায়ন হয়নি অধিকাংশ ধারা। চুক্তিটি আমার বয়সের চেয়ে বেশি। তবে চুক্তিটির ভূমিসহ মৌলিক বিষয়গুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে এখনও আমাদের কথা বলতে ও আন্দোলন করতে হচ্ছে। চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় ঘরের বাইরে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হচ্ছে।’ এমনই আক্ষেপ ও হতাশার কথা জানালেন রাঙামাটির সরকারি কলেজের অনার্স পড়ুয়া শিক্ষার্থী প্রিয়ন্তি চাকমা। 

আরেক পাহাড়ি যুবক করুন জ্যোতি চাকমা আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য। কিন্তু এখনও পাহাড়ি-বাঙালির মধ্যে অবিশ্বাসের কারণে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। এ থেকে উত্তোরণের একমাত্র উপায় হলো, চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া যত দীর্ঘ ও কালক্ষেপণ করা হবে, ততই সমস্যা বাড়বে। 

শুধু প্রিয়ন্তি ও করুন জ্যোতি নন, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি নিয়ে পাহাড়ের তরুণ-তরুণীরা সবাই হতাশ। এই অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে আজ সোমবার পার্বত্য চুক্তির ২৭ বছর পূর্তি উদযাপন হচ্ছে। এ উপলক্ষে আজ পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে রাজধানীর বেইলি রোডে পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্সে আলোচনা সভা আয়োজন করা হয়েছে। সভায় বক্তব্য দেবেন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ও সাবেক রাষ্ট্রদূত সুপ্রদীপ চাকমা। এ ছাড়া এ উপলক্ষে গতকাল বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির উদ্যোগে ধানমন্ডি উইমেন্স ভলান্টিয়ারি অ্যাসোসিয়েশন মিলনায়তনে আলোচনা সভা হয়। আদিবাসী ফোরামের সহসভাপতি অজয় এ মৃয়ের সভাপতিত্বে সভা সঞ্চালনা করেন জনসংহতি সমিতির সদস্য ব্রিজিনাদ চাকমা। 

সভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক খাইরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, অনেক আশা নিয়ে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কিন্তু এই আশা হতাশায় পর্যবসিত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে আমরা ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন’ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলেছি। 
কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান বলেন, রাষ্ট্র আদিবাসীদের কীভাবে মূল্যায়ন করে সেটি এখনও স্পষ্ট নয়। আজকে পার্বত্য চট্টগ্রামে শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের সামরিক-বেসামরিকভাবে পৃষ্ঠপোষকতা জুগিয়ে যাচ্ছে। তিনি পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের নির্দিষ্ট সময়সীমা এবং রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানান। 
সভায় আরও বক্তব্য দেন কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় সম্পাদক ডা. সাজেদুল হক রুবেল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. স্নিগ্ধা রেজওয়ানা, আদিবাসী ফোরামের সহসাধারণ সম্পাদক ডা. গজেন্দ্রনাথ মাহাতো প্রমুখ। 

দীর্ঘ দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে চলা সশস্ত্র সংঘাত অবসানে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তি সই হয়। এরপর পাঁচটি রাজনৈতিক সরকার এবং দুটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় থাকলেও এই চুক্তি বাস্তবায়নে কোনো সরকারই রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে এগিয়ে আসেনি। 
সংশ্লিষ্টরা জানান, পাহাড়ের প্রধান সমস্যা ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ২০০১ সালে গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন ২০১৬ সালে জাতীয় সংসদে বিরোধার্থক ধারা সংশোধন হয়। তবে আইন সংশোধনের পরও ভূমি কমিশনের বিধিমালা তৈরি হয়নি। একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে নিয়োগ দিয়ে তিন বছর মেয়াদে এ পর্যন্ত ছয়বার কমিশনের চেয়ারম্যান পরিবর্তন হলেও ভূমি বিরোধ সমস্যা সমাধান হয়নি। এ নিয়ে সংক্ষুব্ধদের কাছ থেকে প্রায় ২৩ হাজারের বেশি আবেদন জমা পড়লেও নিষ্পত্তি হয়নি। ইতোমধ্যে ষষ্ঠবার নিয়োগ পাওয়া কমিশনের চেয়ারম্যানের মেয়াদও শেষ হয়েছে। নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়নি। 

পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে দীর্ঘায়িত হওয়ায় ছয়টি আঞ্চলিক দলের সৃষ্টি হয়েছে। আগে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য জনসংহতি সমিতি ও প্রসিত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) নামে দুটি দল ছিল। পরবর্তী সময়ে জেএসএসের নেতা সুধাসিন্ধু খীসা ও রূপায়ণ দেওয়ানের নেতৃত্বে জেএসএস (এমএন লারমা গ্রুপ) নামে আত্মপ্রকাশ ঘটে। এ ছাড়া গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ ও মগ পার্টি ও কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামে আরও একটি দল জন্মলাভ করে। এসব দল বর্তমানেও পরস্পরের মধ্যে সংঘাতে লিপ্ত।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী মুজিবুর রহমান বলেন, বিশাল বৈষম্য রেখে এ পার্বত্য চুক্তিটি করা হয়েছে। এ জন্য এটি বাতিল করতে হবে। বর্তমান সরকার চুক্তি বাস্তবায়নে ফলপ্রসূ উদ্যোগ নেবে বলে আশা বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের পার্বত্যাঞ্চলের সভাপতি প্রকৃতি রঞ্জন চাকমার।


 

আরও পড়ুন

×