ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

রাত হলেই সচল পুকুর খননযন্ত্র

রাত হলেই সচল পুকুর খননযন্ত্র

তাড়াশের দোবিলায় প্রায় ৫০ বিঘা ফসলি জমিতে খনন করা হচ্ছে পুকুর। শুক্রবার তোলা সমকাল

এম আতিকুল ইসলাম বুলবুল, তাড়াশ (সিরাজগঞ্জ)

প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:২৬

পুকুর খননের কাজে ব্যবহৃত এক্সক্যাভেটর বা খননযন্ত্র সারাদিন অলস পড়ে থাকে। তবে সন্ধ্যার পরপরই তা সচল হয়ে ওঠে। রাত পেরিয়ে ভোর পর্যন্ত ফসলি জমিতে চলে পুকুর খননের কাজ। চলনবিল অধ্যুষিত সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলায় তিন ফসলি জমিতে এভাবে চলছে অবৈধ কর্মকাণ্ড। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান ও জেল-জরিমানা এড়াতে এ কৌশল বেছে নেন জমির মালিক। ভূমি ব্যবস্থাপনা নীতিমালাও মানেন না তারা।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, জমির মালিকরা উপজেলার ৩৫ থেকে ৪০টি স্থানে পুকুর খনন করছেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রশাসন নানান কাজে ব্যস্ত থাকায় নির্বিঘ্নে এ কাজ করছেন তারা। রাতে ফসলি জমির শ্রেণিই বদলে ফেলছেন। উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। মাগুড়া বিনোদ ইউনিয়নের দোবিলা, নওগাঁ ইউনিয়নের মহিষলুটি, ভায়াট গ্রামের ফসলি মাঠে প্রায় ৪০ বিঘার একটি, পৌর এলাকার আজিমনগর, শ্মশান ঘাট এলাকায় পুকুর খনন চলছে।
কাউরাইল গ্রামে দুটি, মাধাইনগর ইউনিয়নের পৌষার-মাধাইনগর সড়কের পাশে প্রায় ১৮ বিঘার একটি, তাড়াশ-সলঙ্গা আঞ্চলিক সড়কের সোনাপাতিল সড়কের পাশেও চলছে পুকুর খনন। বোয়ালিয়া গ্রামের কৃষক মানিক সরকারের ভাষ্য, প্রভাব খাটিয়ে সব ম্যানেজ করে অবৈধভাবে পুকুর খনন চলছে। এতে মালিকরা মাছ চাষ করে লাভবান হলেও জলাবদ্ধতায় কৃষকের ক্ষতি হচ্ছে। সরাপপুরের কৃষক মো. আয়নাল হোসেন বলেন, এলাকার ঝুরঝুরি, বোয়ালিয়া, সরাপপুর, জাহাঙ্গীরগাঁতি ও তাড়াশ সদর ইউনিয়নের সাত থেকে আটটি গ্রামের মাঠ বছরের আট-নয় মাস ডুবে থাকে। এতে ফসল আবাদ করা যাচ্ছে না। এমন চলতে থাকলে পরিবারের সদস্যদের ভাত জুটবে না।
উপজেলা কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭-০৮ সালের আগে আটটি ইউনিয়ন ও পৌর এলাকায় আবাদি জমি ছিল প্রায় সাড়ে ২৪ হাজার হেক্টর। এসব জমির উর্বর মাটিতে ধান, গম, ভুট্টা, সরিষা, আলু, সবজিসহ তিন ফসল হতো। কিন্তু ২০০৮ সালের পর গণহারে পুকুর খনন শুরু হয়। গত দেড় দশকে চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার হেক্টর জমিতে ১০ হাজারের অধিক পুকুর খনন করা হয়েছে। 
এমন কর্মকাণ্ডে ধানসহ নানান ফসলের উৎপাদন কমেছে। অথচ পরিসংখ্যান বলছে, ২০০১-০২ সালেও সিরাজগঞ্জ জেলার মধ্যে বোরো, আমন ধান উৎপাদনে তাড়াশ উপজেলা ছিল প্রথম। যত্রতত্র ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন করে শত শত পুকুর খনন করায় আবাদি জমি কমার সঙ্গে সঙ্গে খাল, খাসজমি, ব্রিজ, কালভার্টের মুখ বন্ধ হয়ে গেছে। এতে ৫০ থেকে ৬০টি গ্রামের ফসলি মাঠে জলাবদ্ধতায় অন্তত চার হাজার হেক্টর জমি আবাদের অযোগ্য হয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
ভুক্তভোগী কৃষকরা জলাবদ্ধতা নিরসনে নানা ধরনের প্রতিবাদ ও আন্দোলন করেছেন। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান ও জেল-জরিমানা, মামলা, গ্রেপ্তারসহ নানান পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর পরও পুকুর খনন বন্ধ হয়নি। এ বছরও শুষ্ক মৌসুম শুরুর পর ফের পুকুর খনন শুরু করেছেন ভূমি মালিকরা। 
আজিমনগর এলাকায় পুকুর খননকারী গপেন্দ্রনাথের ভাষ্য, তাঁর জমির আশপাশে অনেক পুকুর খনন হয়েছে। এতে তাঁর জমিতে জলাবদ্ধতার কারণে আবাদ করতে পারছেন না। বাধ্য হয়ে তিনি পুকুর খনন করছেন। ভায়াট এলাকার আমিরুল ইসলাম বলেন, প্রতি বিঘা পুকুর লিজে ৫০ হাজার টাকা আসে। পাঁচ বিঘায় বছরে পাওয়া যায় আড়াই লাখ টাকা। ফসলের আবাদে এত টাকা পাওয়ার সুযোগ কম। উৎপাদন খরচও আছে। পুকুরে খরচ ছাড়াই লিজের টাকা পাওয়া যায়।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, অবৈধভাবে খনন করা পুকুর বাড়ছে। দেড় দশকে চার থেকে পাঁচ হাজার হেক্টর তিন ফসলি জমি কমেছে। প্রায় সাত হাজার বিঘা জমি জলাবদ্ধ হয়েছে। এতে ধানসহ খাদ্যশস্য উৎপাদন কমেছে। 
তাড়াশ থানার ওসি মো. আসলাম হোসেনের ভাষ্য, পুকুর খনন বন্ধে ইউএনও এবং সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। সহকারী কমিশনার (ভূমি) খালিদ হাসান বলেন, পুকুর খনন চক্র রাতে কাজ করে। অভিযান চালিয়ে জেল-জরিমানা করলেও তা থামছে না। এলাকার বাসিন্দাদেরও সচেতন হতে হবে। তা না হলে পুকুর খনন বন্ধ করা কঠিন।
 

আরও পড়ুন

×