ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

কথা রাখেনি এনটিসি কর্তৃপক্ষ রেখেছেন শ্রমিকরা

কথা রাখেনি এনটিসি কর্তৃপক্ষ রেখেছেন শ্রমিকরা

মাধবপুরের তেলিয়াপাড়া চা বাগানের কারখানায় সুনসান নীরবতা সমকাল

মাধবপুর ও চুনারুঘাট (হবিগঞ্জ) প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২২:৪৭

তিন মাস পর ন্যাশনাল টি কোম্পানির (এনটিসি) ১২টি চা বাগানের হাহাকার ঘোচার কথা ছিল। নীতিনির্ধারকরা প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করায় শেষ পর্যন্ত তা আর হয়ে ওঠেনি। তবে কর্তৃপক্ষ কথা না রাখলেও, রেখেছেন ক্ষুধা আর সংকটে জর্জরিত শ্রমিকরা। টাকা না পেলেও সংশ্লিষ্টদের আশ্বাসে বিশ্বাস রেখেই কাজে যোগ দিতে শুরু করেছেন তারা।
গেল বৃহস্পতিবার (৫ ডিসেম্বর) প্রথম ধাপে বকেয়া মজুরির একাংশ বুঝে পেয়ে শুক্রবার কাজে ফেরার কথা ছিল চা শ্রমিকদের। প্রতিশ্রুতি অনুসারে তাদের টাকা বুঝিয়ে দিতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। তবে তাদের সেই আশ্বাসকে পুঁজি করেই পূর্বঘোষণা অনুসারে নির্ধারিত দিনেই কাজে ফিরতে শুরু করেছেন চা শ্রমিকরা।
শুক্রবার এনটিসির আওতাধীন মৌলভীবাজারের ৮টি চা বাগানে কাজে যোগ দিয়েছে কর্মবিরতিতে থাকা চা শ্রমিকদের একাংশ। তবে চুনারুঘাট এবং মাধবপুর এলাকার বাগানগুলোতে কাজে যোগ দেননি শ্রমিকরা। চুনারুঘাট উপজেলার লস্করপুর ভ্যালির এনটিসির ৩টি ফাড়িসহ ৭টি বাগানের চা শ্রমিকরা কাজে ফেরার কথা থাকলেও  বকেয়া পরিশোধ না করায় তারা যাননি। রোববার বকেয়া পরিশোধের শর্তে তারা কাজে ফিরবেন বলে জানা গেছে। এ তথ্য জানিয়েছেন  চণ্ডীছড়া চা বাগানের শ্রমিক সুহেল বাবু। একই কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নিপেন পাল।
এর আগে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সিলেটে অবস্থিত এনটিসির ১২টি চা বাগানে কর্মরত শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি, রেশনসহ অন্যান্য পাওনা পরিশোধের ক্ষেত্রে একটি সিদ্ধান্ত নেয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ১ ডিসেম্বর এ নিয়ে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে বিভাগীয় শ্রম দপ্তরের সভাকক্ষে এনটিসির সঙ্গে চা শ্রমিক ও কর্মচারীদের ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয়। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি ধাপে ধাপে পরিশোধ করবে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ন্যাশনাল টি কোম্পানি (এনটিসি)।
দায়িত্বশীলদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বৃহস্পতিবার প্রথম ধাপে শ্রমিকরা মোট ছয় সপ্তাহের বকেয়া মজুরির মধ্যে দুই সপ্তাহের মজুরি পাবেন। সেই সঙ্গে মাসিক বেতনধারী শ্রমিকদের এক মাসের বেতন পরিশোধ করা হবে। বাকি চার সপ্তাহের বকেয়া মজুরি আগামী ৩১ মার্চের মধ্যে কিস্তিতে পরিশোধ করা হবে। এ ছাড়া চলতি ডিসেম্বর মাস থেকে প্রতি সপ্তাহে নিয়মিতভাবে মজুরি পাবেন চা শ্রমিকরা। এ অবস্থায় কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে কাজে ফেরার ঘোষণা দিয়েছেন তারা।
তিন মাস ধরে এনটিসির ১২টি চা বাগানের প্রায় সাড়ে ১২ হাজার শ্রমিক মজুরি পাচ্ছেন না। এই শ্রমিকরা চা বাগানের কাজের ওপরই নির্ভরশীল। মজুরি না পাওয়ায় শ্রমিকরা অমানবিক দুর্দশার মধ্যে পড়েন। অনেকের পক্ষে প্রতিদিনের খাবার জোগাড় করা কঠিন হয়ে পড়েছে। বাধ্য হয়ে অনেক শ্রমিক চা বাগানের বাইরে কম পারিশ্রমিকে কাজ করছেন। সবার পক্ষে প্রতিদিন কাজ জোটানোও সম্ভব হচ্ছে না। যার পরিপ্রেক্ষিতে বকেয়া মজুরি পরিশোধের দাবিতে চলতি বছরের ২১ অক্টোবর থেকে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি শুরু করেন এনটিসির চা শ্রমিকরা।
মাধবপুর উপজেলার তেলিয়াপাড়া চা বাগানের চা শ্রমিকরা জানান, একজন চা শ্রমিকের দৈনিক হাজিরা মাত্র ১৭৮ টাকা। সেই সঙ্গে সপ্তাহে দেওয়া হয় সাড়ে ৩ কেজি আটা। এত স্বল্প মজুরি আর রেশনে সংসার চালানো দায়। তার মধ্যে মজুরি বকেয়া থাকলে চা শ্রমিকদের চুলায় হাঁড়ি ওঠে না। বাগানের কাজের প্রতি মায়ামমতা বেশি থাকায় বংশপরম্পরায় তারা এ কাজ করে যাচ্ছেন। এ ছাড়া শ্রমিকরা বাগানবিমুখ হলে দেশের চা শিল্প ধসে যাবে।
এনটিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) কে এম এমদাদুল হক জানান, শ্রমিকদের বকেয়া পরিশোধের ক্ষেত্রে কৃষি ব্যাংক থেকে অর্থ সহায়তা নেওয়া হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তিপত্র আবশ্যক। নিয়ম অনুসারে ব্যাংকের নীতিগত কাজ সম্পাদন বিলম্বিত হওয়ায় বৃহস্পতিবার শ্রমিকদের টাকা দেওয়া সম্ভব  হয়নি। তবে শিগগির তারা টাকা পেয়ে যাবেন। শ্রমিকরা কাজে ফিরতে শুরু করেছেন। সবাই মিলে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই চালাতে হবে। চা শিল্প ও এনটিসির সংশ্লিষ্টরা সর্বোতভাবে শ্রমিকদের পাশে থাকবেন।
শ্রমিক নেতা স্বরজিত পাশি বলেন, বাগান পরিচালনায় যেখানে সমস্যা রয়েছে, সেগুলো আগে সমাধান করতে হবে। তা না হলে বারবার সংকটে পড়ে বাগান চিরতরে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বিগত সময়ে যারা বাগান পরিচালনা করতে গিয়ে অনিয়ম করেছে, তাদের বিচারের আওতায় নেওয়া দরকার।
এনটিসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, চা বাগানে সংকট দেখা দেয় ২০১৯ সালের কভিড মহামারি শুরুর পর থেকে। সেই সংকট আরও জটিল হয়েছে কোম্পানির দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্টদের অনিয়ম আর গাফিলতির কারণে। চা বাগানকে লোকসান গুনতে হয়েছে। একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চায়ের বাজার আটকে দিয়ে সুবিধা নিয়েছে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের একটি অসাধু চক্র।

আরও পড়ুন

×