ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

আইন ভেঙে যত্রতত্র ভাটা বনের কাঠে পুড়ছে ইট

আইন ভেঙে যত্রতত্র ভাটা বনের কাঠে পুড়ছে ইট

ঘাটাইলে ফরিদ ইটভাটায় স্তূপ করে রাখা হয়েছে পাহাড়ি টিলা কাটার লাল মাটি সমকাল

মাসুম মিয়া, ঘাটাইল (টাঙ্গাইল)

প্রকাশ: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:৩২

অধিকাংশ ইটভাটা স্থাপন করা হয়েছে লোকালয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায়। কিছু ভাটা বন ঘেঁষে। কিছু ভাটার অবস্থান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘেঁষে। অনেকগুলোর আবার নেই নিবন্ধন। ইট পোড়ানো হচ্ছে কাঠ দিয়ে।
ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৯ এবং ১৯৮৯ সালের ইট পোড়ানো নিয়ন্ত্রণ আইন (সংশোধিত-২০০১) অনুযায়ী একটি ভাটাও স্থাপন করা হয়নি। তবু মিলেছে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র। মিলেছে নিবন্ধন। ঘাটাইল উপজেলায় এ বছর ইট পোড়ানো হচ্ছে ৩৮টি ভাটায়। যার মধ্যে নিবন্ধন রয়েছে ২১টির। ইটভাটা নিয়ন্ত্রণ আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশ। হুমকিতে জীববৈচিত্র্য।
ঘাটাইল ইটভাটা মালিক সমিতির তথ্যমতে, উপজেলায় ৩৮টি ইটভাটার মধ্যে ২১টির নিবন্ধন রয়েছে। ১৪টি ভাটা চলছে হাইকোর্টে রিট করে। তিনটি ভাটার তথ্য নেই তাদের কাছে।
ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৯ অনুযায়ী– বিশেষ কোনো স্থাপনা, রেলপথ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও ক্লিনিক, গবেষণা প্রতিষ্ঠান কিংবা অনুরূপ কোনো স্থান বা প্রতিষ্ঠান থেকে কমপক্ষে ১ কিলোমিটার দূরে ইটভাটা স্থাপন করতে হবে। কিন্তু সরেজমিন দেখা যায়, রসুলপুর ইউনিয়নের রসুলপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘেঁষে স্থাপন করা হয়েছে মেসার্স যমুনা ব্রিকস। দূরত্ব ৬০-৭০ গজ। ইটভাটার কালো ধোঁয়া এবং ধুলাবালুর কারণে শ্রেণিকক্ষে বসে থাকতে কষ্ট হয় বলে জানায় চতুর্থ শ্রেণির এক শিক্ষার্থী। ওই বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আমজাদ হোসেন বলেন, শিক্ষার্থীদের পাঠদানে সমস্যা হয়। ভাটার মালিক প্রভাবশালী। তাই লিখিতভাবে কোথাও জানানো হয়নি। 
ওই ভাটার মালিক ইউপি চেয়ারম্যান কাজী মাহবুবুল হক মাসুদ। তাঁর বক্তব্য জানতে কল দিলে ফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। স্থানীয়দের দাবি, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই আত্মগোপনে রায়েছেন চেয়ারম্যান মাসুদ।
এ ছাড়া ধলাপাড়া কলেজ ঘিরে রেখেছে কয়েকটি ইটভাটা। ভাটাগুলোর দূরত্ব কলেজ কেন্দ্র থেকে অর্ধকিলোমিটারও হবে না। ইটভাটার ধোঁয়া দরজা-জানালা দিয়ে ঢুকে লেখাপড়ার পরিবেশ নষ্ট হয় বলে জানান কলেজের অধ্যক্ষ সোহেল রানা খান। 
লোকালয়ে ভাটা স্থাপন করায় স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়েছে মানুষের। ইটভাটার কালো ধোঁয়ার পাশাপাশি গ্রামীণ সড়কে ইটবাহী ও মাটিবাহী ট্রাক চলাচলে উড়ছে ধুলাবালু। নষ্ট হচ্ছে গ্রামীণ সড়ক। চলাচলে মানুষের বাড়ছে দুর্ভোগ। শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। ধুলাবালুতে বিবর্ণ হয়ে পড়ছে গাছপালা ও বাড়িঘর। 
ধলাপাড়া ইউনিয়নের কোনাবাড়ি এলাকায় কথা হয় পথচারী হাসনা বেগমের (৪৫) সঙ্গে। তাঁর ভাষ্য, রাস্তায় ধুলার কারণে নাকে-মুখে কাপড় চেপে চলাচল করতে হয়। নতুন কাপড় পরে বের হওয়া যায় না।
ঘাটাইল উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আবু নইম মোহাম্মদ সোহেল বলেন, ইটভাটার কালো ধোঁয়া ও বালুতে শিশু ও বৃদ্ধদের সর্দি, কাশি ও শ্বাসকষ্ট হতে পারে। এ রোগ বারবার দেখা দিলে শিশুদের স্বাস্থ্যহানি ঘটে। ফলে পড়াশোনায় মনোযোগ কমে যায়।
১৯৮৯ সালের ইট পোড়ানো নিয়ন্ত্রণ আইন (সংশোধিত-২০০১) অনুযায়ী, সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও জনবসতিপূর্ণ এলাকার ৩ কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা স্থাপন এবং ইট পোড়ানো নিষিদ্ধ। এই আইনের ছিটেফোঁটাও মানা হয়নি ঘাটাইলে ইটভাটা স্থাপনে। সব ভাটাই স্থাপন করা হয়েছে জনবসতিপূর্ণ এলাকায়। ঘাটাইলে বনভূমির পরিমাণ ২৫ হাজার ৭১১ একর। এলাকাবাসী জানায়, দিন-রাতে ট্রাক ভরে বনের কাঠ যায় ইটের ভাটায়। সরেজমিনেও মেলে সত্যতা। উপজেলার পূর্ব এলাকার বিভিন্ন ভাটা ঘুরে দেখা যায়, জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে কাঠ। এলাকাবাসীর শঙ্কা, এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই ধ্বংস হয়ে যাবে বন। অথচ জিগজ্যাগ পদ্ধতিতে স্থাপন করা এসব ভাটায় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করার কথা কয়লা। ভাটা মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে প্রতি টন কয়লার দাম ১৯ হাজার ৫০০ থেকে ২০ হাজার টাকা। অপরদিকে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে প্রতি টন কাঠ।
শুধু বনের গাছ নয়, কাটা হচ্ছে টিলাও। টিলার লাল মাটি যাচ্ছে ভাটায়। সরেজমিন সংগ্রামপুর ইউনিয়নের সংগ্রামপুর এলাকায় ফরিদ ইটভাটায় গিয়ে দেখা যায়, স্তূপ করে রাখা হয়েছে পাহাড়ি লাল মাটি।
কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানো অধিকাংশ ভাটার দূরত্ব ধলাপাড়া রেঞ্জ অফিস থেকে ১ কিলোমিটারও হবে না। তবু কাঠ পোড়ানোর বিষয়ে অবগত নন বলে জানান রেঞ্জ কর্মকর্তা ওয়াদুদুর রহমান। 
ঘাটাইল ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি মো. শাহজাহান বলেন, বন ধ্বংস করে ইট পোড়ানো সমিতি সমর্থন করে না। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসংলগ্ন ইটভাটা স্থাপন এটা আইনগত একটা বিষয়। 
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) বিভাগীয় সমন্বয়কারী গৌতম চন্দ্র চন্দের ভাষ্য, কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানো বেআইনি এবং লোকালয়ে ভাটা স্থাপন নিষিদ্ধ। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে পরিবেশ তার ভারসাম্য হারাবে।
টাঙ্গাইল পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মিয়া মাহমুদুল হক বলেন, অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে ভাটাগুলোর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ঘাটাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন ইসলাম বলেন, আইন অনুযায়ী যদি ভাটাগুলো পরিচালিত না হয়, তবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আরও পড়ুন

×