চট্টগ্রাম নগরে ৭ বছরে সড়কে মৃত্যুর ৫৫ শতাংশ পথচারী
মাত্র ১৯ শতাংশে ফুটপাত আছে সেগুলোও বেদখল

চট্টগ্রাম নগরীর সড়কে ঝুঁকিপূর্ণ মোড়গুলোর একটি জিইসি। পথচারী পারাপারের কোনো ব্যবস্থা নেই এখানে। গাড়ির ফাঁক গলে সড়ক পার হতে হয় পথচারীকে। প্রায়ই ঘটে দুর্ঘটনা। মঙ্গলবার তোলা - মো. রাশেদ
আব্দুল্লাহ আল মামুন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:৪৭ | আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৮:১৩
পথচারীর নির্বিঘ্নে যাতায়াতে পর্যাপ্ত ফুটপাত নেই চট্টগ্রামে। যা আছে তার অধিকাংশ বেদখল। ফলে বাধ্য হয়ে সড়কের ওপর দিয়ে হাঁটতে হয়। মোড়গুলোতেও নেই পথচারী পারাপারের ব্যবস্থা। তাই প্রাণ হাতে নিয়েই সড়ক পার হতে হয়। এতে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। বিশ্লেষকরা বলছেন, গত সাত বছরে চট্টগ্রামের সড়কে দুর্ঘটনায় নিহতদের অর্ধেকের বেশি পথচারী। সড়ক দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর হার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। তিন বছরে সড়কে পথচারী মৃত্যু বেড়েছে ৬০ শতাংশ। বিপরীতে কোনো উদ্যোগ নেই নগর কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক)।
চসিকের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম নগরে সড়ক আছে ১ হাজার ৪৪২ কিলোমিটার। বিপরীতে ফুটপাত আছে মাত্র ২৮১ কিলোমিটার; যা মোট সড়কের মাত্র ১৯ শতাংশ। এর মধ্যে অধিকাংশ অবৈধ দখলে। এমনকি ফুটপাতে দোকানও বরাদ্দ দিয়েছে সিটি করপোরেশন।
গত ১৫ ডিসেম্বর ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রপিস ইনিশিয়েটিভ ফর গ্লোবাল রোড সেফটি (বিআইজিআরএস) প্রকাশিত চট্টগ্রাম সিটি রোড সেফটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৭ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫৬৯ জন। এর মধ্যে পথচারীর সংখ্যা ৩১৩, অর্থাৎ ৫৫ শতাংশ। ২০১৭ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে সড়কে পথচারী মৃত্যুর হার বেড়েছে ৬০ শতাংশ। গত তিন বছরে পথচারীর মৃত্যু আরও বেড়েছে। ২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের ৫৪ জন পথচারী। ২০২২ সালে ৬০ জন। ২০২৩ সালে ৫৬ জন। ২০২০ সালে নিহত হন ৩৩ জন। তিন বছরে (২০২১-২০২৩) সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের ৫৮ শতাংশ পথচারী। এ ছাড়া ২৭ শতাংশ মোটরসাইকেল এবং সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক ও যাত্রী, ৮ শতাংশ চার চাকার যানবাহনের চালক ও যাত্রী এবং সাইকেল আরোহী ৭ শতাংশ।
সড়ক দুর্ঘটনাগুলোকে বিশ্লেষণ করে গবেষকরা বলছেন, চট্টগ্রাম নগরের ২০টি মোড় ও ১০টি সড়ক দুর্ঘটনার জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে সিটি গেট, আউটার রিংরোডের খেজুরতলা, বারিক বিল্ডিং মোড়, সিঅ্যান্ডবি ও কালামিয়া বাজার মোড় সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক। তিন বছরে এ মোড়গুলোতে ২৯ জন নিহত হয়েছেন। রুটগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক বহদ্দারহাট থেকে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত সড়ক। এই পাঁচ কিলোমিটার সড়কে ২৪ জন নিহত হয়েছেন।
পথচারীর জন্য কেন বেশি ঝুঁকি
চট্টগ্রামের সড়কে পথচারীর মৃত্যু কেন বেশি, তার কিছু সুনির্দিষ্ট কারণ বের করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ। তাঁর মতে, চট্টগ্রামের সড়কগুলো পথচারীবান্ধব নয়। এখানে পথচারীর নির্বিঘ্নে চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত ফুটপাত নেই; যা আছে তার মধ্যে কিছু অবৈধ দখলে, কিছু ভাঙাচোরা। তাছাড়া যেখানে দখলমুক্ত ফুটপাত আছে, সেখানেও অসমতল ও ধারাবাহিকতা নেই। বাধ্য হয়ে সড়ক দিয়ে যাতায়াত করেন পথচারীরা। মোড়গুলোতে যাত্রী পারাপারের কোনো ব্যবস্থা নেই। ট্রাফিকের হাতের ইশারায় যখন যানবাহন পার হয়, তখন গাড়ির ফাঁক গলে পথচারীরা সড়ক পার হন। আধুনিক কোনো ট্রাফিক ব্যবস্থাও নেই। গতিসীমাও নির্ধারণ করা নেই। পথচারীও অসচেতন।
তিনি আরও বলেন, সন্ধ্যায় ভারী যানবাহনচাপায় পথচারী নিহতের ঘটনা বেশি ঘটে। কারণ, এ সময় পণ্যবাহী ভারী গাড়িগুলো সড়কে নামে। গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণ না থাকায় পথচারীরা চাপা পড়ে মারা যান। এ জন্য মোড়গুলোর আগে গতি নিয়ন্ত্রণে স্পিড হাম্প বসানো ও পথচারী আইল্যান্ড তৈরি করতে হবে।
ফুটপাত কাগজে আছে, বাস্তবে নেই
চসিকের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, নগরে ২৮১ কিলোমিটার ফুটপাত রয়েছে। বাস্তবে অধিকাংশ সড়কের ফুটপাতে চলাচলের সুযোগ নেই। হয়তো ফুটপাতগুলো সড়কের পাশের দোকানিরা দখল করে রেখেছেন, নয়তো হকারদের দখলে। স্বয়ং সিটি করপোরেশন নগরের বিভিন্ন এলাকায় ফুটপাতে প্রায় ৩০০ দোকান বরাদ্দ দিয়েছে।
সংস্থাটির বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিবছর ১৭ থেকে ২০ কিলোমিটার ফুটপাত নির্মাণ করে সিটি করপোরেশন। এ ফুটপাত কোথায় নির্মাণ করা হয়, তার কোনো বিবরণ নেই। ফলে প্রতিবেদনে ফুটপাত নির্মাণের কথা বলা হলেও, বাস্তবে তার দেখা মিলছে না।
এ প্রসঙ্গে সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, ফুটপাত অবৈধ দখলমুক্ত করতে উদ্যোগ নিয়েছি। হকারদের জন্য হলিডে মার্কেট করা হবে। এরপর তাদের সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে। এ ছাড়া পথচারী পারাপারে জেব্রা ক্রসিং ও ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ করা হচ্ছে।
- বিষয় :
- পথচারী নিহত