ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

অবসরে যাওয়ার আগে কৃষি কর্মকর্তার বদলি বাণিজ্য

অনিয়মে যুক্ত ছিলেন চুয়াডাঙ্গার উপপরিচালকসহ কয়েকজন

অবসরে যাওয়ার আগে কৃষি কর্মকর্তার বদলি বাণিজ্য

মো. আজগর আলী

 সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০১:১০ | আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৮:৫০

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আমিরুল হক মাঠে কাজ করতে গিয়ে কৃষকের প্রিয় হয়ে ওঠেন। সুখ-দুঃখে তাঁকে পাশে পান কৃষকরা। কিন্তু গত ৫ ডিসেম্বর হঠাৎ বিনা নোটিশে আমিরুলকে মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলায় স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়। খবর পেয়ে ফুঁসে ওঠেন কৃষকরা। তারা আমিরুলের বদলি বাতিল চেয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে বিক্ষোভ করেন। পরবর্তী সময়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মাসুদুর রহমান সরকারকে দিনভর অবরুদ্ধ করেও বদলি ঠেকানো যায়নি।

কৃষকদের অভিযোগ, কর্মকর্তাদের কাছ থেকে নিয়মিত নানা অজুহাতে টাকা দাবি করেন মাসুদুর রহমান। টাকা দিতে ব্যর্থ হলেই ওই কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের যশোর অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক আজগর আলীও এই অনিয়মে জড়িত। 

এক মাসে তিনি শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বদলি করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ১১ ডিসেম্বর চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার আগে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে এসব করেছেন। তিনি এই অনিয়মে চুয়াডাঙ্গার উপপরিচালক মাসুদুর রহমানকে ব্যবহার করেছেন।

আজগর আলীর শেষ সময়ে বদলির মধ্যে আছেন– হিসাবরক্ষক, কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার, স্টোরকিপার, নিরাপত্তা প্রহরী, সংগনিরোধ কর্মকর্তা, প্লান্ট অবজারভার, উপসহকারী উদ্যান কর্মকর্তা, অতিরিক্ত কৃষি কর্মকর্তা, জেলা প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা, গাড়িচালক, অফিস সহায়ক। দায়িত্ব ছাড়ার আগে একযোগে বদলি শুরু করেন তিনি। এই কাজে তিনি একাধিক ঘনিষ্ঠজনকে ব্যবহার করেছেন। 

আদেশগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অর্থের বিনিময়ে অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে তাদের বাড়ির কাছে বদলি করা হয়েছে। অবশ্য তাদের এই সুবিধা দিতে গিয়ে কাউকে কাউকে দূরে সরাতে হয়েছে। শতাধিক বদলি করা হলেও বিষয়টি লুকাতে অনেক আদেশ ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি।

ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে, মাত্র এক মাসে বদলি, পদায়নসহ ৮৯টি আদেশ জারি হয়েছে। এর মধ্যে ৩৫ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্র, উপজেলা কৃষি অফিস ও হর্টিকালচার সেন্টারে বদলি করা হয়েছে। কাউকে পছন্দের এলাকায় বদলি করতে গিয়ে আবার অনেককে কোনো অভিযোগ ছাড়াই দূরের এলাকায় বদলি করা হয়েছে। প্রায় সব কর্মকর্তাকে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়েছে। উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাকে বদলির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ও জেলা কর্মকর্তার সুপারিশ বিবেচনায় নেওয়ার প্রচলিত নিয়ম থাকলেও, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোনো নিয়ম মানা হয়নি। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জেলা কৃষি কর্মকর্তা বলেন, তাঁর অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীর বদলির ক্ষেত্রে ওই কর্মকর্তার সুপারিশ নেওয়া হয়নি। উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে একই কর্মস্থলে ৩০ থেকে ৩৫ বছর কাটানোর নজিরও আছে। অথচ এসব কর্মকর্তাকে মাত্র কয়েক মাস পরই বদলি হতে হয়েছে। ছোট পদের কর্মকর্তারা এমন বদলিতে বেশি বিপদে পড়েছেন। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ না থাকলে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয় না। অথচ এখানে অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়েছে। এমন ঘটনায় মাঠ পর্যায়ে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। 

হর্টিকালচার সেন্টারের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বদলির ক্ষেত্রে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার উইংয়ের পরিচালকের সঙ্গে আলোচনার বিধান থাকলেও, ১১ উপসহকারী উদ্যান কর্মকর্তা ও তিন কর্মচারীর বদলির ক্ষেত্রে এই নিয়ম অনুসরণ করা হয়নি বলে জানা গেছে।

অভিযোগ উঠেছে, ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে যশোর অঞ্চলে বদলি বাণিজ্যের নতুন সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এই সিন্ডিকেটে একাধিক উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার নাম উঠে এসেছে, যারা সংশ্লিষ্ট জেলা কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে বদলি বাণিজ্য করে আসছেন। মাঠ পর্যায়ের বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ‘আওয়ামী লীগ’ সমর্থক বলে প্রচার করে বদলির ভয় দেখিয়ে টাকা নেওয়ার অভিযোগও উঠেছে। 
বদলি বাণিজ্যের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের যশোর অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক আজগর আলী বলেন, বদলি একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া। এটি যে কোনো সময় হতে পারে।

তিনি আরও বলেন, আমি দীর্ঘদিন বঞ্চিত ছিলাম। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর পদোন্নতি পেয়েছি। আমাকে যশোর কৃষি বিভাগ সংস্কারের জন্য বলা হয়েছে। আমি নিয়ম মেনে সংস্কার করেছি। যাদের বদলি করা হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ আছে। তিন বছর পরই বদলির জন্য জনপ্রশাসন থেকে নিয়ম আছে।

এ বিষয়ে কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। আমরা এটি খতিয়ে দেখব। বদলি ঘিরে কোনো অনিয়ম হয়ে থাকলে ব্যবস্থা নেব।

আরও পড়ুন

×