ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

এক দালালে ৪ রোহিঙ্গার পাসপোর্ট

এক দালালে ৪ রোহিঙ্গার পাসপোর্ট

চার রোহিঙ্গার পাসপোর্টের চূড়ান্ত কপি। ইনসেটে দালাল আহসান উল্লাহ সমকাল

সোহাগ খান সুজন, শরীয়তপুর

প্রকাশ: ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২২:৫০ | আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১১:২৯

শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে গত ১৮ নভেম্বর ভোটার হতে আসে নুর হোসেন ও ইয়াসিন নামে দুই তরুণ। সেখানে তথ্য যাচাইয়ের সময় সুন্দর বাংলায় উত্তর দেয় ইয়াসিন। তবে ভুল বাংলায় কথা বলার সময় ধরা পড়ে যায় নুর হোসেন। নির্বাচন কর্মকর্তার জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে, ওই দু’জনই মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত নাগরিক রোহিঙ্গা। এ ঘটনায় মামলা হলে পুলিশ দু’জনকে গ্রেপ্তার করে। সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয় তাদের নিয়ে আসা একই উপজেলার বাসিন্দা আহসান উল্লাহকে। পরে জানা যায়, আগেই চার রোহিঙ্গাকে নিজ সন্তান পরিচয়ে পাসপোর্ট করিয়ে দিয়েছে আহসান। নুর হোসেনম ইয়াসিনকেও একই কায়দায় পাসপোর্ট করিয়ে দেওয়ার জন্য চুক্তি করেছে। সে জন্যই ভোটার তালিকায় তাদের নাম ওঠাতে সহায়তা করছিল। 

আহসান উল্লাহ কোদালপুর ইউনিয়নের মধ্য দেওয়ানপাড়া গ্রামের কামাল উদ্দিনের ছেলে। চার রোহিঙ্গার পাসপোর্টে বাবা হিসেবে তার নাম ও মা হিসেবে তার স্ত্রী আছিয়া বেগমের নাম দেওয়া হয়। ইতোমধ্যে তাদের তিনজন পাসপোর্ট পেয়ে গেছে। তারা হলো– ছলিমা আক্তার, মোস্তফা কামাল ও আরাফাত রহমান। এদের মধ্যে ছলিমা গত ১০ সেপ্টেম্বর পাসপোর্টের জন্য বায়োমেট্রিক সম্পন্ন করে; বুঝে পায় ১৪ অক্টোবর। তার পাসপোর্টের নম্বর এ১৬৪৫৫০৫০। এ ছাড়া মোস্তফা কামাল ২ সেপ্টেম্বর পাসপোর্টের জন্য বায়োমেট্রিক করে, বুঝে পায় ১১ সেপ্টেম্বর। তার পাসপোর্টের নম্বর এ১৬০৯২৮৯৭। কামালের সঙ্গে একই দিন বায়োমেট্রিক করে একই তারিখে পাসপোর্ট পায় আরাফাত রহমান। তার পাসপোর্ট নম্বর এ১৬০৯২৮৯৯। এ ছাড়া জিয়াউর রহমান গত ১২ নভেম্বর পাসপোর্টের জন্য বায়োমেট্রিক করে। ৩ ডিসেম্বর সেটি নেওয়ার কথা ছিল। সেটি এখন আটকে গেছে। 
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রোহিঙ্গারা তাদের নাম-পরিচয় গোপন করে স্থানীয় কোনো পরিবারের স্বামী-স্ত্রীকে বাবা-মা দেখিয়ে জনপ্রতিনিধি ও নির্বাচন অফিসের কিছু কর্মচারীকে ম্যানেজ করে ভোটার আইডি কার্ড বানাচ্ছে। স্থানীয় কিছু দালাল অসাধু জনপ্রতিনিধিকে হাত করে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রও (এনআইডি) তৈরি করছে। পরে এসবের মাধ্যমে পাসপোর্ট বানিয়ে বাংলাদেশি সেজে বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিচ্ছে রোহিঙ্গারা। এ প্রক্রিয়ায় টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে দালাল চক্র।

জানা যায়, ১৮ নভেম্বর গ্রেপ্তার ইয়াসিন ২০১৮ সালে মিয়ানমার থেকে ভারত হয়ে বাংলাদেশে আসে। পরে আইয়ুব আলী নাম নিয়ে ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলার কালিন্দী ইউনিয়ন থেকে জন্মসনদ সংগ্রহ করে। পরে শরীয়তপুরের গোসাইরহাটের ভোটার হতে উপজেলা নির্বাচন অফিসে আসে। অপর রোহিঙ্গা নুর হোসেন মিয়ানমার সীমান্তবর্তী জেলা কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের দমদমিয়া গ্রামে আশ্রিত। সে শরীয়তপুরের নাওডোবা ইউনিয়নের জন্মসনদ নিয়েছে। পরে গোসাইরহাটের আহসান উল্লাহকে বাবা ও তার স্ত্রী আসিয়া বেগমকে মা সাজিয়ে ভোটার হওয়ার আবেদন করে।

এ ঘটনার সূত্রে নির্বাচন কর্মকর্তারা আহসান উল্লাহর জাতীয় পরিচয়পত্রের অনুসন্ধান শুরু করেন। এ সময় তার নামের বিপরীতে আরও চারজন রোহিঙ্গাকে জাতীয় পরিচয়পত্র করে দেওয়ার তথ্য মেলে। অনুসন্ধানে জানা যায়, আহসান উল্লাহ প্রায় ৩০ বছর চট্টগ্রামে আছে। সেখানে মুদি দোকান ছিল। সেই সুবাদে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরে জনপ্রতি ৩০ হাজার টাকার চুক্তিতে জাতীয় পরিচয়পত্র করে পাসপোর্ট বানিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে নিজ গ্রামের বাড়ি কোদালপুর ইউনিয়নের মধ্য দেওয়ানপাড়ায় নিয়ে আসে।

জিয়াউর রহমান, মোস্তাফা কামাল, আরাফাত রহমান ও ছলিমা আক্তারের জন্মনিবন্ধন হয়েছে কোদালপুর ইউনিয়ন পরিষদ থেকে। তাদের আবেদনপত্রে বাবার নাম আহসান উল্লাহ ও মায়ের নাম আসিয়া বেগম লেখা। অথচ আহসান উল্লাহ-আসিয়া বেগম দম্পতির তিন ছেলে। তারা হলো– আহসান ইকরাম উল্লাহ দেওয়ান, মাহফুজুর রহমান মিরাজ, মো. মাহিন। চার রোহিঙ্গার জন্মনিবন্ধনে সুপারিশ করেন একই ইউপির ৫ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য আবুল কালাম দেওয়ান। জন্মসনদে সই দিয়েছেন ইউপি চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান ও ইউপি সচিব রিমা পাল। জানা যায়, এই সনদের পাশাপাশি নাগরিকত্ব সনদসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে গোসাইরহাট উপজেলা নির্বাচন আফিসে জাতীয় পরিচয়পত্রে জন্য আবেদন করে চারজন। ওই কার্যালয়ের ডাটা এন্ট্রি অপারেটর আক্তার হোসেন কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা আবু দাউদকে দেন। তিনি ওই চারজনের নামে জাতীয় পরিচয়পত্র ইস্যু করেন। এসবের বিপরীতে আবেদন করে তিনজন পাসপোর্ট পান।

আহসান উল্লাহর ভাষ্য, সে প্রতি পাসপোর্টের বিনিময়ে ৩০ হাজার টাকা পেয়েছে। তিন রোহিঙ্গা পুরুষ ও এক নারীকে এভাবে পাসপোর্ট করিয়ে দিয়েছে। আরও দুই রোহিঙ্গার সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল। তাদের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির সময় ১৮ নভেম্বর গ্রেপ্তার হয়েছিল। ১৫ দিন পর ছাড়া পায়।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে কোদালপুর ইউপির ৫ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য আবুল কালাম দেওয়ানের মোবাইল ফোনে কল দিয়ে নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানের ভাষ্য, আহসান উল্লাহ তাঁর ইউনিয়নের স্থায়ী বাসিন্দা। সন্তানদের নিয়ে জন্মসনদ নিতে এসেছিল, তখন দিয়েছেন। তারা যে রোহিঙ্গা– তিনি জানতেন না। প্রতারণা করে জন্মসনদ নেওয়ায় তার বিচার হবে।

জেলা পাসপোর্ট অফিসার নাজমুল হাসান বলেন, ‘প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে আমাদের কাছে এলে যাচাই-বাছাই করে বায়োমেট্রিক করে পুলিশের কাছে তদন্তের জন্য দিই। পুলিশ সরেজমিন তদন্ত করে পক্ষে প্রতিবেদন দিলেই আমরা পাসপোর্ট দিই। আমরা পুলিশি তদন্তের ওপরই নির্ভরশীল।’ চার রোহিঙ্গা যে পাসপোর্ট নিয়েছে– সেটি তারা এখনও শনাক্ত করতে পারেননি। পুলিশ কোনো  প্রতিবেদন দেয়নি বলেও মন্তব্য করেন তিনি। 
সব কাগজপত্র দেখেই পক্ষে প্রতিবেদন দিয়েছিলেন বলে জানান পুলিশের এসআই সুলায়মান কাজী। তাঁর ভাষ্য, রোহিঙ্গা জানতে পারলে পক্ষে প্রতিবেদন দিতেন না। জেলা পুলিশ সুপার মো. নজরুল ইসলাম বলেন, পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য যা যা ডকুমেন্ট দরকার সবই তারা দিয়েছে। পরে অধিকতর তদন্তে রোহিঙ্গা ভোটারের বিষয়ে জেনে আহসান উল্লাহর বিরুদ্ধে মামলা হয়।

ওই চার রোহিঙ্গার ভোটার নিবন্ধনের সময় গোসাইরহাটের নির্বাচন কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন মো. আবু দাউদ। তিনি এখন কুষ্টিয়া সদরের দায়িত্বে। আবু দাউদের ভাষ্য, ‘জাতীয় পরিচয়পত্র করার জন্য তারা সব কাগজপত্র দিলে যাচাই-বাছাই করে সব সঠিক পাই। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে তাদের চেহারার মিল পাইনি। ওরা ভালো বাংলাও বলতে পারে। তাই আমরা বুঝতে পারিনি।’

জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা আবদুল মান্নান জানান, আহসান উল্লাহ দু’জন রোহিঙ্গাকে ভোটার করতে এলে উপজেলা অফিসারের সন্দেহ হয়। তাদের আটক করে মামলার পর কারাগারে পাঠানো হয়। পরে আহসানের এনআইডির তদন্তে আরও চার রোহিঙ্গাকে সন্তান পরিচয়ে ভোটার করানোর তথ্য পান। ব্যবস্থা নিতে নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিয়েছেন।

আরও পড়ুন

×