ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

কালিয়াকৈর

মাটি যাচ্ছে ইটভাটায় কমছে কৃষিজমি

মাটি যাচ্ছে ইটভাটায় কমছে কৃষিজমি

কালিয়াকৈরের দেওয়ার বাজার এলাকায় এভাবেই ফসলি জমির মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে। ছবি: সমকাল

 এম তুষারী, কালিয়াকৈর (গাজীপুর)

প্রকাশ: ০৯ জানুয়ারি ২০২৫ | ০৪:৪৮

গাজীপুরের কালিয়াকৈরের বিভিন্ন এলাকার ফসলি জমির মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে ইটভাটায়। এতে কমছে কৃষিজমি, নষ্ট হচ্ছে জমির উর্বরাশক্তি। ট্রাকে মাটি পরিবহন করায় সড়ক নষ্ট হয়ে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

কৃষক ও এলাকাবাসীর অভিযোগ, এ অঞ্চলের তিন ফসলি জমি থেকে কাটা হচ্ছে মাটি। সেই মাটি যাচ্ছে ইটভাটায়। ২০-২৫ ফুট গভীর করে মাটি কাটায় আশপাশের কৃষিজমিও ভেঙে পড়ছে। এ ঘটনায় উদ্বিগ্ন উপজেলার বাংগুরী ও চিনাইল এলাকার ভূমি মালিক ও কৃষকরা। তারা মনে করেন, স্থানীয় প্রশাসন তৎপর হলে প্রভাবশালী মাটি ব্যবসায়ীদের কার্যক্রম বন্ধ করা সম্ভব।

গত শনিবার উপজেলার ঢালজোড়া ইউনিয়নের বাংগুরী, দেওয়ার বাজার ও চিনাইল, মধ্যপাড়া ইউনিয়নের চাঁনপুর, অলিয়ারচালা ও মকসবিল এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, শত শত বিঘা জমিতে ধান ও সরিষা আবাদ করা হয়েছে। এসব এলাকার বিভিন্ন জায়গায় ২০-২৫ ফুট গভীর করে মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে ইটভাটায়। এতে পরিবেশের যেমন ক্ষতি হচ্ছে, তেমনি মাটির ট্রাক চলাচল করায় রাস্তাঘাটও নষ্ট হচ্ছে।

জমির মালিক ও কৃষকরা জানান, কিছু জমির মালিক নানা কারণে এ বছর চাষাবাদ করতে পারেননি। সেসব জমি থেকে উপজেলার সাজনধরা এলাকার মোজাম্মেল হোসেন ও মো. লিটন, বান্ধাবাড়ি এলাকার শহিদুল ইসলাম ও রজব আলী প্রভাব খাটিয়ে কিছু দিন ধরে মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছেন। তারা জমির কয়েকজন মালিককে কিছু টাকা দিলেও অনেককে না জানিয়েই ভেকু দিয়ে নির্বিচারে মাটি কেটে বিক্রি করছেন। সাধারণত প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হয় মাটি কাটা, চলে গভীর রাত পর্যন্ত। মাটি কাটার পর তা নিয়ে যাওয়া হয় পার্শ্ববর্তী ইটভাটায়। এতে কমে যাচ্ছে উর্বর আবাদি জমি। অন্যদিকে মাটি বহনকারী ডাম্প ট্রাকের দাপটে রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।

চিনাইল এলাকার কৃষক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, যারা মাটি কাটছেন, তারা নাকি একটি রাজনৈতিক দলের অনেক বড় নেতা। তারা ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে জোর করেই মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি জানান, তাঁর চাচার জমি থেকে মাটি কাটা হয়েছে। বিষয়টি তিনি জানালে তাঁর চাচা বলেন, জমি থেকে মাটি কাটার বিষয়ে তিনি জানেন না।

বাংগুরী গ্রামের কৃষক শাহ আলম বলেন, ‘অনেক না করছি ওরা তো আমাগো কতা হুনেই না। আমরাও ভয়ের লাইগা কিছুই কই না। জমিগুলার মাটি কাইটা সর্বনাশ কইরা ফালাইছে। আপনারা কিছু একটা করেন।’

মধ্যপাড়া ইউনিয়নের চানপুর, অলিয়ারচালা ও মকসবিল এলাকায় প্রভাবশালীদের মধ্যে রয়েছেন ফরহাদ হোসেন, মুনজু সিকদার, আলাউদ্দিন দেওয়ান, রুবেল হোসেন, সুজন খান, ইউসুব হোসেন, বাদল কাজীসহ ১০-১২ জন। তারা ফসলি জমিসহ চাঁনপুর নদীতীর ও বনের জমি থেকেও মাটি কেটে ডাম্প ট্রাকে ভরে ইটভাটায় বিক্রি করছেন। এলাকাবাসী প্রতিবাদ করলেও তারা শুনছেন না। এসব মাটি ব্যবসায়ী সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে মাটির ব্যবসা করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

মাটিবাহী ডাম্প ট্রাক চলাচলের কারণে আশপাশের প্রায় সব রাস্তাঘাট নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ধুলাবালুর কারণে মানুষ চলাচল করতে পারছে না। এরই মধ্যে দেওয়াইর থেকে কুড়ালকাপা সড়কটির বিভিন্ন স্থান ভেঙে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে গেছে। অপরদিকে, মধ্যপাড়া ইউনিয়নের চাঁনপুর-শাকাশ্বর আঞ্চলিক সড়ক, জানুয়ারভিটি-জামালপুর ইউনিয়ন পরিষদ আঞ্চলিক সড়কসহ কয়েকটি আঞ্চলিক সড়ক একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে। একটু বৃষ্টি হলেই জমে যায় হাঁটু পানি। ট্রাক থেকে সড়কে পড়া মাটি বৃষ্টিতে ভিজে পিচ্ছিল হয়ে যায়। এতে সড়ক দিয়ে হেঁটে চলাচলেও দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

স্থানীয় অনেকেই এর প্রতিবাদ করলে তাদের নানাভাবে ভয়ভীতি দেখানো হয় বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এক জমি থেকে মাটি কেটে নেওয়ায় পাশের জমির মালিকরা ক্ষতির আশঙ্কায় মাটি ব্যবসায়ীদের কাছে জমি বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।

ঢালজোড়া ইউনিয়নের বাংগুরী এলাকায় ফসলি জমির পাশে একটি ভেকু মেরামত করছিলেন রফিকুল ইসলাম নামের এক যুবক। জানতে চাইলে তিনি বলেন, একটি রাজনৈতিক দলের নেতা মোজাম্মেলসহ কয়েকজন মাটির ব্যবসা করছেন।

মাটি ব্যবসায়ী মোজাম্মেল হোসেন বলেন, মাটি কাটছেন না, পুকুর খনন করছেন। পুকুর করে মাছ চাষ করবেন। মধ্যপাড়া ইউনিয়নের চানপুর গ্রামের মাটি ব্যবসায়ী মঞ্জু সিকদার বলেন, তারা যে জমি থেকে মাটি নেন, সেই জমির মালিকদের টাকা দেন। তাদের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অনেক সড়ক তারা নিজেদের অর্থায়নে মেরামত করে দেন বলে দাবি করেন তিনি।

ঢালজোড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) এনায়েত হোসেন বলেন, কয়েকদিন আগে ইউএনও তাঁকে বিষয়টি জানানোর পর তিনি মাটি ব্যবসায়ীদের বলে দিয়েছেন, আর এক ইঞ্চি মাটি কাটা হলে প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, ইটভাটা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠায় ফসলি জমি প্রতি বছরই কমে যাচ্ছে। ফসলি জমি কমে গেলেও তারা নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদন অব্যাহত রাখার চেষ্টা করছেন। ফসলি জমির মাটি কেউ কেটে নিলে সেই জমিতে ফসল ফলাতে ও মাটি উর্বর করতে কয়েক বছর সময় লেগে যায়।

কালিয়াকৈরের ইউএনও কাউছার আহাম্মেদ বলেন, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানদের দিয়ে মাটি কাটার কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর পরও মাটি কাটা হলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

আরও পড়ুন

×