‘নন্দিতা সুরক্ষা’ অদম্য নারীদের উদ্যমী প্রয়াস

করোনাকালে মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন নন্দিতা সুরক্ষার কর্মীরা
হাসানউজ্জামান, ফরিদপুর
প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২০ | ০৬:১০
করোনাকালে ফরিদপুরের মানুষের কাছে অতি আপন একটি নাম ‘নন্দিতা সুরক্ষা’। বিশেষ করে শহর ও আশপাশের হতদরিদ্র ছিন্নমূল নারী ও শিশুরা নাগরিক মননের কঠিন এ শব্দগুচ্ছ বলতে না পারলেও এই সংস্থার ধবল রঙের মেয়েটিকে ভালোই চেনে। কারণ কখনো খাবারের প্যাকেট, কখনো ইফতারি অথবা সামান্য কিছু মাস্ক নিয়ে হলেও দুচারজন সহযোগীসহ তাদের কাছে ছুটে গেছেন তিনি।
ধবল রঙের সেই মেয়েটির নাম তাহিয়াতুল জান্নাত রেমি। তিনি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘নন্দিতা সুরক্ষা’র প্রতিষ্ঠাতা। বর্তমানে ফরিদপুরের সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের অনার্স শেষ বর্ষে পড়ছেন তিনি।
সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে মানুষের জন্য কিছুর করার অদম্য ইচ্ছা শক্তি নিয়ে শিশুর প্রতি যৌন সহিংসতা বন্ধে কাজ শুরু করেছিল রেমি’র গড়ে তোলা সংগঠনটি। এরপর একে একে ফরিদপুরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ছাত্রীদের জন্য মাসিক বান্ধব করে তোলার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাসিক সুরক্ষ্যা ব্যাংক তৈরির কাজ, মাসিক সচেতনতা, জরায়ু ও স্তন ক্যানসার সচেতনতা, বাল্যবিবাহ রোধ, মানসিক বিষন্নতা দূর করা, নারীপুরুষ সমতা সহ সমাজের বেদে, মেথর বা পরিচ্ছন্ন কর্মী, তৃতীয় লিঙ্গের সম্প্রদায়ের মত নিগৃহীত জনগোষ্ঠী নিয়ে কাজ করছেন তারা ।
চলতি বছরের শুরুতেই ফরিদপুর জেলা ও সদর উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেয়া একটি ছোট প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করে সংগঠনটি। ওই প্রকল্পের মাধ্যমে ফরিদপুর সদর উপজেলার ৩০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাসিক সুরক্ষা ব্যাংক স্থাপন করে রেমি ও তার দল।
কোভিড১৯ পরিস্থিতিতে ‘নন্দিতা সুরক্ষা’য় যোগ হয় ভিন্নমাত্রা। কাজ ও দায়িত্বের পরিধি বেড়ে যাওয়ায় তাই কেবল নারীর স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা নয়, সংগঠনটি কাজ শুরু করে মানুষের খাবার ও প্রয়োজনীয় উপকরণ এবং স্যানিটারি ন্যাপকিন নিয়ে। এই মহামারির ভয়াবহতার মধ্যে নন্দিতা সুরক্ষার কয়েকজন নারী গ্রাম থেকে গ্রামে বিধবা, অসহায়, বৃদ্ধা নারীদের জন্য ব্যাগ ভর্তি বাজারের সাথে সাবান, মাস্ক, স্যানিটারি ন্যাপকিন বিরতণ করা শুরু করেছিলেন সেই এপ্রিল থেকেই, যা এখনো চলমান।
রেমি জানান, কাজের পথটা এতটা সহজ ছিলনা তার জন্য। প্রতিনিয়ত নানা জনের নানা মন্তব্য, অপমান, অপবাদ মাথায় নিয়েও কাজ করতে হয়েছে নিজের মনবল নিয়ে। তিনি আরও জানান, মাসিক ও যৌন হয়রানির মত স্পর্শকাতর বিষয়গুলি নিয়ে এদেশে একজন তরুণীর কথা বলাটা অনেকের কাছেই নেতিবাচক ও অনুচিত বলে বিবেচিত। এর মধ্যেই সমাজের সচেতন মানুষদের অনুপ্রেরনা নিয়ে প্রতিনিয়ত নারীর মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায়, নারীর ক্ষমতায়ন, নারীদের স্বাবলম্বী করে তুলতে সকলের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা করে যাচ্ছে ‘নন্দিতা সুরক্ষা’র একঝাঁক তরুন উদ্যমী নারী।
নন্দিতা সুরক্ষার সাধারণ সম্পাদক কাস্পিয়া কল্লোল নবনীতা জানান, এই মহামারিতে যেখানে মানুষ দৈনন্দিন বাজার করতে পারছে না সেখানে স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। এই পরিস্থতিতে তারা অস্বাস্থ্যকর মাসিক উপকরণ ব্যবহার করতে বাধ্য হবেন যার ফলাফল হতে পারে ভায়বহ। এতে যেকোন সময় তারা নানা রোগে আক্রান্ত হতে পারে, এই উপলব্ধি মাথায় রেখেই তারা ভিন্নমাত্রার এই কাজ শুরু করেছেন।
নবনীতা বলেন, আমার নিজের ও পরিবারের স্বাস্থ্য ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে আমি নিজে মাঠ পর্যায়ে যেতে না পারছি না । কিন্তু স্বাস্থ্য বিধি মেনে আমাদের সভাপতি রেমি চার মাস ধরে নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। যে এলাকায় আমাদের সংগঠনের কাজ হচ্ছে সেই এলাকার কর্মীরা সাথে যাচ্ছে তার।
তাহিয়াতুল জান্নাত রেমি জানান, করোনার এই কঠিন সময়েও যেন পুরুষের মত নারীরাও অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারেন সেজন্য কিছু ক্ষুদ্র প্রজেক্ট শুরু করেছেন।
রেমি বলেন, এত বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হয়েও স্বপ্ন দেখি একদিন আলো ফুটবে, অবসান ঘটবে সকল অসমতার, সংস্কার হবে জরাজীর্ণ সমাজব্যবস্থার। একদিন এদেশে আর কোন ধর্ষনের ঘটনা ঘটবে না, হবে না ধর্ষণের বিচার চেয়ে মানবন্ধন। প্রতিবছর অসচেতনায় নারীদের জীবন বিপর্যস্ত হবে না। মুক্তচিন্তা নিয়ে এগিয়ে যাবে দেশ।
- বিষয় :
- ফরিদপুর
- নন্দিতা সুরক্ষা