ট্রান্সফরমারে ইলেকট্রনিক ডিভাইস তালা দিয়েও বন্ধ হচ্ছে না চুরি

ফাইল ছবি
জয়পুরহাট প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৪ এপ্রিল ২০২৫ | ২৩:৫৬
কোথাও লোহার খাঁচায় পুরে শিকলে বেঁধে রাখা হচ্ছে, কোথাওবা গায়ে সেঁটে দেওয়া হয়েছে ইলেকট্রনিক ডিভাইস ও হাইড্রোলিক হর্ন। অনেকে অতিরিক্ত টাকা খরচ করে পাহারাও বসিয়েছেন; কিন্তু কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না ট্রান্সফরমার ও মিটার চুরি।
এ চিত্র জয়পুরহাট জেলার পাঁচ উপজেলার ফসলের মাঠের। চলতি বোরো মৌসুমে এসব মাঠের গভীর ও অগভীর নলকূপ থেকে ১৬১টি ট্রান্সফরমার ও ৭১টি মিটার চুরি হয়েছে। এর মধ্যে সদরে ১৪টি ট্রান্সফরমার ও ৩টি মিটার, পাঁচবিবিতে ৩৬টি ট্রান্সফরমার ১০টি মিটার, আক্কেলপুরে ২১টি ট্রান্সফরমার ও ২৯টি মিটার, কালাইয়ে ৭৬টি ট্রান্সফরমার ও ১৫টি মিটার এবং ক্ষেতলালে ১৪টি ট্রান্সফরমার ও ১৪টি মিটার চুরি হয়েছে। প্রতিটি ঘটনায় মালিকরা থানায় এজাহার দিয়েছেন। পুলিশ দু-একজনকে আটক করলেও অধিকাংশই পার পেয়ে গেছে। একের পর এক ট্রান্সফরমার ও মিটার চুরির ঘটনায় সেচপাম্প নিয়ে আতঙ্কে রয়েছেন গভীর-অগভীর নলকূপ মালিকরা। অনেকেই ট্রান্সফরমার চুরির পর মাঠে সেচ কার্যক্রম বন্ধও রেখেছেন। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্তারা মাইকিং করে সেচ কৃষকদের সচেতন থাকতে বলে দায় সারছেন। ক্ষতি যা হওয়ার হচ্ছে কৃষকদের। তারা সেচযন্ত্রের নিরাপত্তা নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
দেড় মাস আগে কালাই উপজেলার আপলাপাড়া মাঠে থাকা আতাউর রহমানের গভীর নলকূপের ১০ কেভির দুটি ট্রান্সফরমার চুরি হয়। পল্লী বিদ্যুৎ অফিসে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা জমা দিয়ে ফের দুটি ট্রান্সফরমার লাগান। এর তিন দিন পর আবার তিনটি ট্রান্সফরমার চুরি হয়। থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন।
আতাউর রহমান বলেন, ট্রান্সফরমার চোর শনাক্তে থানা পুলিশের ভূমিকা তেমন জোরালো নয়। চুরির ভয়ে ট্রান্সফরমার না কিনে সেচ দেওয়া বন্ধ রেখেছি। নিজের জমিতে পার্শ্ববর্তী গভীর নলকূপ থেকে সেচ দিচ্ছি।
৩ এপ্রিল চোরেরা ক্ষেতলালের দক্ষিণ বস্তা গ্রামের শওকত আলীর গভীর নলকূপের ড্রেনম্যানকে বেঁধে রেখে ১০ কেভির ৩টি ট্রান্সফরমার, তার ও ব্যারেল খুলে নিয়ে গেছে। এর পর থেকে সেচ কার্যক্রম বন্ধ। এ ঘটনার ১৫ দিন আগেও ওই সেচযন্ত্র থেকে বৈদ্যুতিক মিটার চুরি হয়। একই কৌশলে জেলার অধিকাংশ সেচপাম্পের ট্রান্সফরমার নিয়ে গেছে চোরেরা।
শওকত আলী বলেন, চোরেরা চিরকুটে বিকাশ নম্বর লিখে টাকা চাচ্ছে। টাকা দিলে মিটার ফেরত দিচ্ছে। অথচ তাদের ধরতে পারছে না পুলিশ। এমনকি থানায় এজাহার করলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেগুলো মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করা হচ্ছে না।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, পুরো জেলায় শতাধিক গভীর নলকূপ মালিকের কাছে চাঁদা চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ২০ হাজার টাকা করে না দিলে সেচ বন্ধ থাকবে বলে মোবাইলে হুমকিও দেওয়া হয়েছে। ভয়ে অনেকে টাকা দিয়েছেন। কেউ সেচ বন্ধ রেখেছেন। এদিকে চুরির পর চোরদের টাকা দিয়ে মিটার ফেরত পেলেও পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ তা গ্রহণ করছেন না। একদিকে চোরদের টাকা দিতে হচ্ছে, অন্যদিকে নতুন মিটার কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে।
১৫ মার্চ রাতে ক্ষেতলালের বসতা গ্রামের সেচপাম্প মালিক শাহিন আলমের লোহার খাঁচার ভেতর থেকে মিটার চুরি হয়েছে। চোরদের ফেলে যাওয়া চিরকুটে থাকা বিকাশ নম্বরে ১০ হাজার টাকা দিয়ে মিটার ফেরত এনেছেন। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি জানার পর সেই মিটার বাতিল করে সংযোগ বিছিন্ন করেছে। নতুন করে ১৪ হাজার টাকা সমিতিতে জমা দিয়ে মিটার কিনতে হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে হয়তো সেচ কার্যক্রম বন্ধ রাখতে হবে।
কালাই পৌর শহরের কালীমহুর মহল্লার গভীর নলকূপ মালিক তানজিরুল ইসলাম রানা চুরির ভয়ে ট্রান্সফরমারে ইলেকট্রিক ডিভাইস সংযোগ করেছেন। মিটার লোহার খাঁচায় পুরে তালা দিয়ে রেখেছেন। ট্রান্সফরমারে হাত দিলেই মোবাইল বেজে উঠবে। এখন চোরেরা ২৫ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেছে। তারা ২০ জনের কাছে টাকা চেয়েছে। বিকাশ নম্বর পাঠিয়ে হুমকি দিচ্ছে। টাকা না দিলে ট্রান্সফরমার ও মিটার চুরি হবে। বিষয়টি থানায় অভিযোগ করেও লাভ হয়নি।
পাঁচবিবির চাঁনপাড়া বাজারের ব্যবসায়ী আব্দুল আলিম বলেন, চোরেরা প্রকাশ্যে বিকাশে টাকা নিলেও দেখার কেউ নেই। আসলে এভাবে আর কতদিন চলা যায়।
জয়পুরহাট পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার আবু উমাম মাহবুবুল হক বলেন, জেলায় ৬ হাজার ৯৫২টি ট্রান্সফরমারের মাধ্যমে সেচ কার্যক্রম চলছে। এতগুলো সেচযন্ত্রের নিরাপত্তা দেওয়া সমিতির পক্ষে সম্ভব নয়। পুলিশ প্রশাসনের পাশাপাশি সবাইকে চুরি রোধে এগিয়ে আসতে হবে।
জেলা প্রশাসক ও জেলা সেচ কমিটির সভাপতি আফরোজা আকতার চৌধুরী বলেন, শিগগির এ পরিস্থিতির অবসান ঘটবে।
- বিষয় :
- ট্রান্সফরমার