ঢাকা বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫

চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আপিল বিভাগেই ৮ বছর

চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আপিল বিভাগেই ৮ বছর

ফাইল ছবি

 আবু সালেহ রনি

প্রকাশ: ২৬ এপ্রিল ২০২৫ | ২৩:৫২

নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি ১১ বছরেও। এই হত্যাকাণ্ডের তিন বছরের মধ্যে বিচারের দুটি ধাপ শেষ হয় বিচারিক আদালত ও হাইকোর্টে। ২০১৭ সালে হাইকোর্টের রায়ে ১৫ আসামির মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল এবং অন্য ১১ আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এর বিরুদ্ধে আপিল আবেদন করেন আসামিরা। অথচ আট বছর ধরে সেই আবেদনগুলো আপিল বিভাগে ঝুলে রয়েছে।
আপিলসহ ডেথ রেফারেন্স (আসামিদের মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) আবেদন নিষ্পত্তি না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন নিহতদের পরিবার ও স্বজন। মামলার বাদী সেলিনা ইসলাম বিউটি সমকালকে বলেন, ‘আপিল নিষ্পত্তি না হওয়ায় আসামিদের মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকর হচ্ছে না। চার-পাঁচ আসামি অভিযোগ গঠনের আগে মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এই আসামিরা নানাভাবে হুমকি দিচ্ছেন। এতে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।’ তিনি দ্রুত রায় কার্যকরের প্রত্যাশা করেন।

২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ আদালতে মামলায় হাজিরা দিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জে বাসায় ফেরার পথে অপহৃত হন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজন। তিন দিন পর ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীতে একে একে ভেসে ওঠে ছয়টি লাশ। পরদিন খোঁজ মেলে অন্য লাশটিরও। নিহতরা হলেন– নজরুল ইসলাম, চন্দন সরকার, নজরুলের বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম ও চন্দনের গাড়িচালক মো. ইব্রাহীম। এ ঘটনায় নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি ও চন্দনের জামাতা বিজয় কুমার পাল ফতুল্লা থানায় পৃথক মামলা করেন। এ ঘটনায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী র‍্যাবের কয়েকজন সদস্যও জড়িত ছিলেন। এ নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। নৃশংস এ হত্যা মামলায় ২০১৬ সালের ১৬ জানুয়ারি রায় দেন বিচারিক আদালত। রায়ে ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পরে রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন ২৮ আসামি। ২০১৭ সালের ২২ আগস্ট বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া ১১ আসামিকে যাবজ্জীবন ও বাকি ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন হাইকোর্ট।

হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে র‍্যাব কর্মকর্তা তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেনসহ ১৫ আসামি আপিল বিভাগে আবেদন করেন। অন্যদিকে, যাবজ্জীবন ও বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ডপ্রাপ্তদের সাজা বাড়াতে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। যার শুনানি এখনও শেষ হয়নি।

হাইকোর্টের মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা ১৫ আসামি হলেন– র‍্যাব-১১-এর সাবেক অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, সাবেক দুই কোম্পানি কমান্ডার মেজর (অব.) আরিফ হোসেন, লে. কমান্ডার (চাকরিচ্যুত) এম মাসুদ রানা, সাবেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেন, ল্যান্স নায়েক বেলাল হোসেন, হাবিলদার মো. এমদাদুল হক, আরওজি-১ মো. আরিফ হোসেন, ল্যান্স নায়েক হিরা মিয়া, সিপাহি আবু তৈয়ব আলী, কনস্টেবল মো. শিহাব উদ্দিন, এসআই পুর্ণেন্দু বালা, সৈনিক আবদুল আলিম, সৈনিক মহিউদ্দিন মুনশি, সৈনিক আল আমিন ও সৈনিক তাজুল ইসলাম।
মৃত্যুদণ্ড পরিবর্তন হয়ে যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত ১১ আসামি হলেন– সৈনিক আসাদুজ্জামান নুর, সার্জেন্ট এনামুল কবির, নূর হোসেনের সহযোগী আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান, রহম আলী, আবুল বাশার, মোর্তুজা জামান, সেলিম, সানাউল্লাহ, শাহজাহান ও জামালউদ্দিন। তাদের মধ্যে পাঁচ আসামি পলাতক। তারা হলেন– সৈনিক মহিউদ্দিন মুনশি, সৈনিক আল আমিন, সৈনিক তাজুল ইসলাম, নূর হোসেনের সহকারী সানাউল্লাহ সানা ও ম্যানেজার শাহজাহান। এ ছাড়া বিচারিক আদালতের রায় বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ৯ আসামিও র‍্যাবের বরখাস্তকৃত কর্মকর্তা ও সদস্য। তাদের মধ্যে কনস্টেবল (পরে এএসআই পদে পদোন্নতি পেয়ে নৌ থানায় কর্মরত) হাবিবুর রহমানের ১৭ বছর, এএসআই আবুল কালাম আজাদ, এএসআই কামাল হোসেন, কনস্টেবল বাবুল হাসান, করপোরাল মোখলেসুর রহমান, ল্যান্স করপোরাল রুহুল আমিন ও সিপাহি নুরুজ্জামানের ১০ বছর করে এবং এএসআই বজলুর রহমান ও হাবিলদার নাসির উদ্দিনের সাত বছর করে কারাদণ্ডাদেশ উচ্চ আদালতে বহাল রয়েছে। তাদের মধ্যে মোখলেসুর রহমান ও কামাল হোসেন পলাতক।

আপিল শুনানির বিষয়ে আসামি নূর হোসেনের আইনজীবী এসআরএন লুৎফর রহমান আকন্দ সমকালকে বলেন, ‘বর্তমানে আপিল বিভাগে ২০১৪ ও ২০১৫ সালের ডেথ রেফারেন্স মামলাগুলোর শুনানি চলছে। নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার রায় হয়েছে ২০১৭ সালে। সেই হিসাবে এই মামলার শুনানির জন্য আরও তিন বছর অপেক্ষা করতে হতে পারে।’ তবে তিনি বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি যদি মামলাটিকে অগ্রাধিকার দিয়ে দ্রুত নিষ্পত্তির নির্দেশ দেন, তাহলে সেটি সম্ভব। এ জন্য রাষ্ট্রপক্ষেরও উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।’ তিনি আরও জানান, আসামিপক্ষ থেকে দ্রুত শুনানির জন্য প্রয়োজনীয় আবেদন ইতোমধ্যে দাখিল করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুহাম্মদ আবদুল জব্বার ভূঞা সমকালকে বলেন, মামলাটি অত্যন্ত চাঞ্চল্যকর ও আলোচিত। দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য আসামিদের আপিল শুনানির বিষয়টি প্রধান বিচারপতির এখতিয়ার। কার্যতালিকায় এলে শুনানি শুরু হবে। রাষ্ট্রপক্ষ শুনানির জন্য প্রস্তুত রয়েছে।

আরও পড়ুন

×