রায়গঞ্জে ব্যক্তিগত বন্দিশালা ভাঙচুর, আগুন বিক্ষুব্ধদের
আটকে রাখা হতো মাসের পর মাস

সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার চান্দাইকোনা ইউনিয়নের সোনারাম পূর্বপাড়া গ্রামের এ বাড়ির ভেতরে গোপন নির্যাতন কক্ষের সন্ধান মিলেছে। শুক্রবার সকালে সেখানে আগুন ধরিয়ে দেন স্থানীয় বাসিন্দারা- সমকাল
সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৩ মে ২০২৫ | ০০:৫৫ | আপডেট: ০৩ মে ২০২৫ | ১২:৪৭
সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলায় ব্যক্তিগত বন্দিশালা বা ‘টর্চার চেম্বার’-এর সন্ধান পাওয়া গেছে। সেখানে প্রায় পাঁচ মাস বন্দি থাকার পর মেঝের মাটি খুঁড়ে মুক্ত হন এক বৃদ্ধ ও এক গৃহবধূ। উপজেলার চান্দাইকোনা ইউনিয়নের সোনারাম গ্রামের এ নির্যাতনশালার সন্ধান পাওয়ার পর গতকাল শুক্রবার ভাঙচুর করে আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছেন বিক্ষুব্ধরা।
অভিযোগ রয়েছে, চাঁদা আদায় বা জোরপূর্বক জমি লিখে নিতে সাধারণ মানুষকে ব্যক্তিগত ঘরে জিম্মি ও বন্দি করে মাসের পর মাস আটকে রাখা হতো। চিৎকার করলে অচেতন করতে দেওয়া হতো ঘুমের ইনজেকশন। ব্যক্তিগত বন্দিশালাটি একটি জাতীয় পত্রিকার রায়গঞ্জ প্রতিনিধি, জামায়াতকর্মী ও পল্লিচিকিৎসক নাজমুল হোসেন তালুকদার আরাফাতের। তিনি পশ্চিম লক্ষ্মীকোলা গ্রামের রেজাউল তালুকদারের ছেলে। গতকাল দুপুরে তাঁকে আটক করে পুলিশ। থানায় তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। বিকেলে রায়গঞ্জ প্রেস ক্লাব থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়।
জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হওয়া শিল্পী খাতুন (৫৫) রায়গঞ্জের চান্দাইকোনা ইউনিয়নের লক্ষ্মী বিষ্ণুপ্রসাদ গ্রামের মুনসুর আলীর স্ত্রী এবং আব্দুল জাব্বার (৭৫) একই ইউনিয়নের পূর্ব পাইকোড়া গ্রামের বাসিন্দা। তাদের সেখানে দীর্ঘদিন আটকে রাখা হয়। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে তারা মুক্ত হওয়ার পর এর খোঁজ পান পুলিশ ও স্থানীয়রা। তবে ভুক্তভোগীদের আটকে রেখে কিডনি বিক্রি বা পাচারের চেষ্টার গুঞ্জন স্থানীয়ভাবে ছড়িয়ে পড়লেও পরে এর কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। তাদের শরীরে কাটাছেঁড়ার চিহ্নও মেলেনি।
ওই নির্যাতনশালা ঘিরে কৌতূহলের শেষ নেই রায়গঞ্জবাসীর। উপজেলা সদর থেকে ৬-৭ কিলোমিটার দূরে সোনারাম গ্রামে জহুরুল ইসলামের পুত্র সুমন তালুকদারের মালিকানাধীন দ্বিতল ভবনটি ভাড়া নেন আরাফাত। ভবনের নিচে ছোট ছোট ৩টি কক্ষ নিয়ে তিনি নিজে বন্দিশালা নির্মাণ করেন। এই ঘরের সন্ধান পাওয়ার পর থেকে গতকাল শত শত মানুষ সেটি দেখার জন্য ভিড় করছেন। প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এ ঘটনায় রায়গঞ্জ থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন জাব্বারের ছেলে।
জানা গেছে, আরাফাতের নির্দেশে তাঁর সহযোগী শরীফ মেম্বার, কামরুল ইসলাম, হাফিজুল ইসলাম ও পান্না লোকজনকে ধরে এনে সেখানে আটকে রাখত। দাবিকৃত চাঁদা বা জোরপূর্বক জমিজমা লিখে নিতে বা হাতিয়ে নিতে চালানো হতো নির্যাতন। দ্বিতীয় বিয়ে করিয়ে দেওয়ার প্রলোভনে আব্দুল জাব্বারকে ফাঁদে ফেলে প্রথমে সেখানে আটকানো হয়। এর আগে জমিজমা হাতিয়ে নিতে স্ট্যাম্পে তাঁর জোরপূর্বক স্বাক্ষর নেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় তারা।
এ ছাড়া শিল্পী খাতুনের সঙ্গে আরাফাত ও শরীফ মেম্বারের আগে থেকেই জমিজমা নিয়ে দ্বন্দ্ব ও মামলা ছিল। তাঁকে আটকে রেখে জমিজমা লিখে নেওয়ার চেষ্টা করে এ চক্র। বন্দিদশা থেকে মুক্ত এ গৃহবধূ জানান, জমিসংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে প্রায় ৬ মাস আগে তাদের অপহরণ করা হয়। এক মাস অন্যত্র রাখা হলেও ৫ মাস ধরে জাব্বারসহ তাঁকে এই ঘরেই বন্দি করে রাখা হয়েছিল। মাঝেমধ্যে তাদের শরীরে ইনজেকশন দেওয়া হতো।
ভুক্তভোগী আব্দুল জাব্বার অসুস্থ হওয়ায় তাঁকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। তাঁর ছেলে শফিকুল ইসলাম জানান, গত ৮ নভেম্বর বিকেলে তাঁর বাবা নিখোঁজ হন। পরে কোথাও খুঁজে না পেয়ে ১২ নভেম্বর থানায় জিডি করেন।
মেঝের মাটি খুঁড়ে দু’জন মুক্ত হলে বিষয়টি ফাঁস হয়। আরাফাতকে পুলিশ আটক করলেও বাকিরা পলাতক। এরপর বিক্ষুব্ধ লোকজন লক্ষ্মীকোলা গ্রামে আরাফাতের ফার্মহাউসের সেচ প্রকল্পের ভেতর আরও ৪-৫টি ছোট ছোট নির্মাণাধীন ঘরের সন্ধান পান। এ ঘটনায় বিক্ষুব্ধ লোকজন সুমন ও আরাফাতের বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছেন। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
রায়গঞ্জ থানার ওসি মো. আসাদুজ্জামান বলেন, সোনারাম গ্রামে বন্দিশালা আকৃতির টর্চার চেম্বার মনে হওয়ায় সেসব নিয়ে তদন্ত করছে পুলিশ। ফার্মহাউসের সেচ প্রকল্পের পাশে নির্মাণাধীন ঘরগুলো কী– বোঝা যাচ্ছে না।
সিরাজগঞ্জের পুলিশ সুপার ফারুক হোসেন বলেন, নির্মাণাধীন ভবনের ভেতরে সুড়ঙ্গ আকৃতির ছোট ছোট ঘর বন্দিশালা কিনা, তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ।