ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

নোয়াখালীর সুবর্ণচর

তৃষ্ণা মেটাতে একটি পানির গাড়িই ভরসা

তৃষ্ণা মেটাতে একটি পানির গাড়িই ভরসা

নোয়াখালীর সুবর্ণচরে পানি সংগ্রহের জন্য গাড়ির সামনে দীর্ঘ লাইন সমকাল

জাহিদুর রহমান, সুবর্ণচর (নোয়াখালী) থেকে

প্রকাশ: ১০ মে ২০২৫ | ০১:২১ | আপডেট: ১০ মে ২০২৫ | ০৭:৪৩

সময়টা দুপুরের কিছু আগে। তীব্র রোদ। এর মধ্যে পানির গাড়ি আসার ঘোষণা এলো মসজিদের মাইক থেকে। সঙ্গে সঙ্গে নারী-পুরুষ-শিশু কলসি নিয়ে ছুটল গাড়ির দিকে। পানি শেষ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় কে কার আগে গাড়ির কাছে পৌঁছাবে তার জন্য এ প্রতিযোগিতা। যারা কলসি ভরতে পারলেন তারা ভাগ্যবান; যারা পারলেন না তাদের মুখ বেজার। শুষ্ক মৌসুমে এমন দৃশ্য এখন প্রায়ই দেখা যাচ্ছে নোয়াখালীর উপকূলীয় এলাকা সুবর্ণচর উপজেলায়। এ চিত্রই যেন বলে দিচ্ছে উপকূলীয় এলাকায় সুপেয় পানির সংকট কেমন তীব্র আকার ধারণ করেছে। 

পানি সংগ্রহ করতে আসা সুবর্ণচরের পূর্ব চরবাটা গ্রামের গৃহিণী আমেনা বেগম জানান, বাড়িতে নলকূপ আছে কিন্তু পানি উঠছে না। আশপাশের বাড়িতেও একই অবস্থা। তাই সুপেয় পানির জন্য এনজিওর গাড়ির ওপর ভরসা করতে হয় সবাইকে।

জানা গেছে, সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থা নামে এনজিও একটি গাড়ি দিয়েই বর্তমানে উপজেলা শহরের ১০/১২টি পয়েন্টে বিনামূল্যে পানি সরবরাহ করছে। দেড়-দুই কিলোমিটার দূর থেকে নারীরা গাড়ির কাছে আসেন পানি নিতে। অনেকেই আবার একই সঙ্গে দুই কলসি পানি নেন। এক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে গাড়ি থেকে পানি নিয়ে ফিরছিলেন সাহিদা বেগম। তিনি বলেন, রোজার ঈদের পর স্থানীয় প্রকৌশল অধিদপ্তরের গাড়িতে কিছুদিন পানি দেওয়া হয়। এরপর সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থা মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। সংস্থাটি একটি গাড়িতে পানি দিচ্ছে। এতে কোনো রকম চলে, গাড়ির সংখ্যা বাড়ানো হলে আমাদের উপকার হতো।

আমেনা ও সাহিদার মতো সুবর্ণচরের অসংখ্য মানুষ এখন সুপেয় পানির জন্য নিরন্তর লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। ফাল্গুনের শুরু থেকে জ্যৈষ্ঠের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত পানির সংকট তীব্র হয়। অগভীর বা গভীর নলকূপ এখানে অকার্যকর। বাসিন্দারা জানান, চার-পাঁচ বছর আগেও সুবর্ণচরে এমন চিত্র ছিল না। তখন এলাকায় বোরো চাষ হতো কম। বেশির ভাগ মানুষ রবিশস্য উৎপাদন করত। তাতে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার তেমন ছিল না। কৃষিকাজের জন্য ২৪৫টি সেচ পাম্পের অনুমতি থাকলেও অপরিকল্পিতভাবে বসানো হয়েছে আরও তিন হাজারের বেশি সেচ পাম্প। এতে দিন দিন ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ বেড়েছে।

১১ এপ্রিল থেকে সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থা গাড়িতে সুপেয় পানি বিতরণ করছে। তবে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষের এই উপজেলার অসংখ্য পরিবার এ সুবিধার বাইরে থেকে যাচ্ছে। সুবর্ণচরের ভূঁইয়ারহাট এলাকার বাসিন্দা মুসা মিয়া বলেন, খাওয়ার পানির কষ্ট তো আছেই। এখন পুকুরগুলো সব শুকিয়ে যাচ্ছে। গোসল আর ধোয়া-মোছার পানির সংকটও বড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

সুবর্ণচরের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন চন্দ্রকলির নির্বাহী পরিচালক শাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, কৃষি বিভাগের ভুল নীতির কারণে সুবর্ণচরে পানির জন্য হাহাকার তৈরি হয়েছে। রবিশস্য অধ্যুষিত এলাকায় বোরো ধান চাষ না করার বিষয়ে কৃষি আইন আছে। অথচ স্থানীয় কৃষি বিভাগ এ আইন মানছে না।

সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থার প্রধান নির্বাহী সাইফুল ইসলাম বলেন, এবার পানি সংকট তীব্র। তাই আমরা স্বল্প পরিসরে পানি বিতরণের কার্যক্রম শুরু করি। গত ২১ এপ্রিল কক্সবাজার থেকে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের একটি গাড়ির ব্যবস্থা করেছি। সুপেয় পানি থেকে শুরু করে গাড়ির সব খরচ আমাদের সংস্থা থেকে দিয়েছি। একটি গাড়িতে দৈনিক দুই দফায় ৮ হাজার লিটার পানি বিতরণ করা হয়েছে। সরকার নানাভাবে পানি সংকট সমাধানে কাজ করছে। আমরা বেসরকারিভাবে ছোট পরিসরে হলেও সংকট নিরসনে চেষ্টা করছি। ভবিষ্যতে তৃষ্ণার্ত মানুষের পাশে আমরা আরও বড় পরিসরে থাকব। 

এদিকে পানির সংকটাপন্ন অবস্থা দেখতে আজ শনিবার সুবর্ণচরে আসছেন কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমুল আহসান, স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব রেজাউল মাকছুদ জাহেদী, কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের চেয়ারম্যান রুহুল আমিন খান, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ছাইফুল আলমসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা। তারা বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন শেষে কাল রোববার সকালে উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে পানি সংকট নিরসনে করণীয় শীর্ষক মতবিনিময় সভায় যোগ দেবেন।‌ সভায় ভুক্তভোগী, কৃষক, এনজিও প্রতিনিধি, পরিবেশবিদ, শিক্ষক, সাংবাদিকসহ স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আসতে পারে।

আরও পড়ুন

×