পটুয়াখালীতে বিএনপি-জিওপির পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি, ১৪৪ ধারা জারি

প্রতীকী ছবি
পটুয়াখালী ও গলাচিপা প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৩ জুন ২০২৫ | ২১:৩৩
বিএনপি ও গণঅধিকার পরিষদের (জিওপি) পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ঘিরে পটুয়াখালীর গলাচিপা ও দশমিনা উপজেলা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করেছে প্রশাসন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ এড়াতে গলাচিপা পৌরসভা ও এর আশপাশের এলাকায় জরুরি অবস্থা জারি করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাহমুদুল হাসান এবং দশমিনায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইরতিজা হাসান।
গলাচিপায় শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে রোববার সকাল ৮টা পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারির কথা উল্লেখ থাকলেও দশমিনায় নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা দেওয়া হয়নি।
এদিকে গলাচিপা ও দশমিনার দুই উপজেলায়ই বিএনপি ও গণঅধিকার পরিষদের নেতাকর্মীদের মধ্যে টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে।
গলাচিপা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাহমুদুল হাসান তার লিখিত আদেশে বলেন, গলাচিপা উপজেলার চর বিশ্বাস ও বকুলবাড়িয়া এলাকায় সংঘটিত সংঘর্ষ ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে বিএনপি ও গণঅধিকার পরিষদের মধ্যে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে এবং উভয় পক্ষের যুগপৎ কর্মসূচি ঘোষণায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সম্ভাবনা রয়েছে বলে গলাচিপা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে অবহিত করেন। এ প্রেক্ষিতে জনগণের জানমাল এবং সরকারি সম্পত্তি রক্ষার্থে গলাচিপা পৌরসভাসহ এর আশপাশ এলাকায় শুক্রবার (১৩ জুন) সকাল ৮টা থেকে রোববার (১৫ জুন) সকাল ৮টা পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। এ সময় উল্লেখিত এলাকায় সভা, সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল, গণজমায়েত, বিস্ফোরক দ্রব্য, আগ্নেয়াস্ত্র ও সকল প্রকার দেশীয় অস্ত্র ইত্যাদি বহনসহ সংশ্লিষ্ট এলাকায় পাঁচ বা ততোধিক ব্যক্তির অবস্থান কিংবা চলাফেরা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এ আদেশ লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় গলাচিপা উপজেলার চর বিশ্বাস বাজারে গণ অধিকার পরিষদ ও বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে এবং ভাংচুর করা হয় বিএনপির কার্যালয়। এ সংঘর্ষে গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরের ছোটভাই আমিনুল ইসলাম নুরসহ উভয় পক্ষের ২০জন নেতাকর্মী আহত হন। এ ঘটনার জন্য গণঅধিকার পরিষদ ও বিএনপির নেতৃবৃন্দ একে অপরকে দায়ী করেছেন।
এ ঘটনার সময় গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর উপজেলার বকুলবাড়িয়া ইউনিয়নের পাতাবুনিয়া এলাকায় সাংগঠনিক সফরে ছিলেন। চর বিশ্বাসের সংঘর্ষের ঘটনার খবর ছড়িয়ে পরলে ওই রাতেই উপজেলার বকুলবাড়িয়া ইউনিয়নের পাতাবুনিয়া এলাকায় নুরুল হক নুরকে অবরুদ্ধ করে রাখে স্থানীয় বিএনপির কর্মী-সমর্থকরা এবং তারা রাস্তায় রাস্তায় গাছ ফেলে ব্যারিকেড দিয়ে রাখেন।
খবর পেয়ে সেনাবাহিনী ও পুলিশ ঘটনাস্থলে যান এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। সেনাবাহিনী ও পুলিশের নিরাপত্তায় রাত ৩টার দিকে ভিপি নুর গলাচিপা শহরে পৌঁছেন। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে নুরুল হক নুর বিকেল সাড়ে ৩টায় গলাচিপায় সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করেন এবং প্রতিবাদ সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। পাশাপাশি উপজেলা বিএনপিও একই কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এতে গলাচিপা শহরসহ পুরো উপজেলা উত্তপ্ত হয়ে উঠলে এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটার আশঙ্কা দেখা দেয়। এ অবস্থায় উপজেলা প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করেন। এর পাশাপাশি দশমিনা উপজেলা প্রশাসনও ১৪৪ ধারা জারি করেন।
এদিকে বিকেল ৪টায় গলাচিপা উপজেলা গেস্ট হাউজ চত্বরে সংবাদ সম্মেলন করেন গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর। তিনি বলেন, ২৪শের গণঅভ্যুত্থানের পূর্বে বিভিন্ন হামলা-মামলার শিকার হয়েছি, হাজারো নেতাকর্মীরা হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন। শত শত তাজা প্রাণের বিনিময়ে ২৪শের গণঅভ্যুত্থান জন্ম হয়েছে। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও স্বৈরাচারী সরকার পতন ঘটিয়ে আজ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে নিরলস ও শান্তিপূর্ণভাবে নিজ এলাকায় রাজনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু আমার দলের জনপ্রিয়তা দেখে বিএনপির বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা হাসান মামুনের অনুসারীরা গলাচিপা ও দশমিনা উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের গণঅধিকার পরিষদের অফিস ভাংচুর, নেতা-কর্মীদের উপর হামলা ও দোকান-বাড়ি ভাংচুরসহ রাজনৈতিক উত্তেজনা সৃষ্টি করছেন। শুধু তাই নয়, একটি ভুল মেসেজ শুনে প্রকৃত বক্তব্য না জেনে সোশ্যাল মিডিয়াতে বিভিন্ন অপপ্রচার করে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, বকুলবাড়িয়াতে পথ সভা করতে গিয়ে হাসান মামুনের অনুসারীদের হাতে রাতভর অবরুদ্ধ করে রেখেছে। রাস্তার ওপর গাছ ফেলে রামদা, হকিস্টিক দেশীয় অস্ত্রসহ মহড়া দিলেও পুলিশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা আমাদের কোনো নিরাপত্তা দিতে পারেনি। আমরা চাইলে এর জবাব দিতে পারতাম। কিন্তু আমরা তা চাইনি। এলাকায় কোন সহিংসতা হোক, আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ুক। তাই নিজেরাই জীবন ঝুঁকি নিয়ে আমরা আমাদের উপজেলায় পৌঁছেছি। এ সময় জেলা, উপজেলার গণঅধিকার পরিষদের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মী উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হাসান মামুন বলেন, নুরুল হক নুরের কর্মীরা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে বিএনপি কার্যালয়ে হামলা করেছে। তার উত্তেজনামূলক বক্তব্য, স্থানীয় প্রশাসনকে টার্গেট করে বক্তব্য এবং বিএনপির নেতৃবৃন্দকে টার্গেট করে বক্তব্য দিচ্ছেন তিনি। আসলে তিনি ঘোলা জলে মাছ শিকার করতে চাচ্ছেন। তাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে- এ সরকারকে ব্যর্থ করে দিয়ে জাতীয় সরকার করা এবং সেই সরকারের ভাগ নিয়ে মন্ত্রী-উপদেষ্টা হওয়া। তারা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যেতে চাচ্ছে না। কারণ, তাদের ভোট দুই পার্সেন্টও নেই। বিএনপির নেতাকর্মীকে নুরুল হক নুর মেনে নিতে পারছে না, তাই তিনি বিএনপিকে এবং বিএনপির নেতৃবৃন্দকে টার্গেট করে বক্তব্য দিয়ে উত্তেজনা পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায়।
তিনি আরও বলেন, ভিপি নুর স্থানীয় কিছু আওয়ামী লীগসহ নেতাকর্মীদের নিয়েছে; যাতে আওয়ামী লীগের ভোট তার পক্ষে যায়। আশা করি তার অসুস্থ রাজনীতির মূল্যায়ন করবে ভোটাররা।
এ ব্যাপারে গলাচিপা থানার ওসি মো. আশাদুর রহমান জানান, গলাচিপার পরিস্থিতি এখন শান্ত এবং ১৪৪ ধারা বলবৎ রয়েছে। জনগণের জানমাল ও শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে প্রশাসন ১৪৪ ধারা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে বদ্ধপরিকর।
প্রসঙ্গত, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের বাড়ি গলাচিপা উপজেলার চর বিশ্বাসে এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হাসান মামুনের বাড়ি দশমিনা উপজেলার রনগোপালদী এলাকায়। দু’জনেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্ব-স্ব দলের প্রার্থী। ৫ আগস্টের পর ২০২৪ সালের ২২ অক্টোবর বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত একটি চিঠি দেওয়া হয় পটুয়াখালী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবকে।
ওই চিঠিতে নুরুল হক নুরকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার জন্য স্থানীয় নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেওয়া হয়। মূলত, এর পর থেকেই ভিপি নুর ও বিএনপি নেতা হাসান মামুনের মধ্যে স্নায়ু লড়াই শুরু হয়। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে গত বৃহস্পতিবার, যা শুক্রবার ১৪৪ ধারা পর্যন্ত গড়িয়েছে।