হুমকিতে তেল, গ্যাস ও জাহাজ চলাচলের পথ

.
সারোয়ার সুমন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ১৫ জুন ২০২৫ | ০১:১৩ | আপডেট: ১৫ জুন ২০২৫ | ০১:১৩
ইরান ও ইসরায়েল কয়েক হাজার মাইল দূরে থাকলেও দু’দেশের সংঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশের অর্থনীতি। লন্ডভন্ড করে দেবে তেল, গ্যাস ও জাহাজ চলাচলের নেটওয়ার্ক। সংঘাত যুদ্ধে রূপ নিলে চট্টগ্রাম বন্দরে এখন যেসব জাহাজ আসা-যাওয়া করছে, সেগুলোর পণ্য পরিবহন খরচ বাড়বে বহু গুণ। বেড়ে যাবে জ্বালানি তেলের দামও। কারণ, বাংলাদেশ এখন যে জ্বালানি তেল আমদানি করছে, এর বেশির ভাগই আসছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে।
চলাচলের সুবিধার্থে এসব জাহাজ এখন হরমুজ প্রণালি ব্যবহার করছে। হরমুজ প্রণালি হচ্ছে পারস্য উপসাগরের একটি জলপথ। ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমানের মাঝখানে অবস্থিত এই সংকীর্ণ জলপথটি বৈশ্বিক তেল বাণিজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
আমেরিকার জ্বালানি তথ্য সংস্থা (ইআইএ) জানায়, প্রতিদিন বিশ্বে যে পরিমাণ তেল ব্যবহার হয়, এর প্রায় এক-পঞ্চমাংশ, অর্থাৎ ১ কোটি ৮০ লাখ থেকে ১ কোটি ৯০ লাখ ব্যারেল তেল হরমুজ প্রণালি দিয়ে পরিবহন হয়। দু’দেশের চলমান উত্তেজনা দীর্ঘায়িত হলে অনেক তেলবাহী ট্যাঙ্কার আটকা পড়বে। তেলের দাম তখন আকাশ ছুঁতে পারে। অপরিশোধিত তেলের দাম এরই মধ্যে এক ঝটকায় ১৩ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। অপরিশোধিত তেলের অন্যতম মানদণ্ড ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ১০ শতাংশের বেশি বেড়ে ব্যারেলপ্রতি ৭৫ দশমিক ১৫ ডলারে দাঁড়ায়, গত পাঁচ মাসে যা সর্বোচ্চ।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে বাংলাদেশের কৃষি ও শিল্পকারখানার উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। দেশে জ্বালানি তেল মজুতের সক্ষমতাও পর্যাপ্ত নেই। মাত্র ৪৫ দিনের জ্বালানি মজুত রাখতে পারে বাংলাদেশ।
অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম বলেন, পরিশোধিত তেল আমদানির কারণে বাংলাদেশের প্রতিবছর ১০ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে। জ্বালানি তেলের দাম যদি আরও বাড়ে, তাহলে এই ব্যয়ের পরিমাণও আনুপাতিক হারে বাড়বে; যা ভোগাবে পুরো দেশকে।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল আলম সুজন বলেন, ‘বাংলাদেশের চাহিদার ৮০ শতাংশ তেল আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। প্রতি মাসে গড়ে সাড়ে ৪ থেকে ৫ লাখ টন জ্বালানি আমদানি করি আমরা। এই তেলের মূল ভোক্তা কৃষক, শিল্পকারখানা ও গণপরিবহন। সংঘাতের প্রভাবে জ্বালানি তেলের দাম এরই মধ্যে বেড়েছে। বেড়ে যাবে জাহাজের পরিচালন খরচও। যার প্রভাব পড়বে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে। তেলের দামের সঙ্গে সবকিছুর সম্পর্ক আছে। ফলে তেলের দাম বাড়লে আবারও মূল্যস্ফীতি বাড়বে আমাদের দেশে।’
ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম চট্টগ্রামের সভাপতি ও বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহসভাপতি এস এম আবু তৈয়ব বলেন, ‘ইরান-ইসরায়েল সংঘাত যুদ্ধে রূপ নিলে বাংলাদেশের রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে সবচেয়ে বেশি। তেলের দাম বেড়ে গেলে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বাড়ার পাশাপাশি পণ্য পরিবহনের খরচও বাড়বে। পাশাপাশি জ্বালানি তেলের সংকটও দেখা দিতে পারে। কারণ, আমাদের দীর্ঘ মেয়াদে তেল মজুত করার সক্ষমতা নেই।’ তিনি জানান, জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে কারখানা পরিচালনার খরচও বাড়বে। তখন ভুগবে দেশের পোশাক খাত। জাহাজ চলাচল ব্যাহত হলে আমাদের শিপমেন্টেও প্রভাব পড়বে, খরচ বেড়ে যাবে অনেকটাই। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর নানা সমস্যায় বিপর্যস্ত পোশাক খাত। নতুন এই সংকট শুরু হলে ক্ষতি হবে অপূরণীয়। এ জন্য জ্বালানি তেলের বিকল্প উৎস আগেভাগে ঠিক রাখতে সরকারের নীতিনির্ধারকদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
ব্যবসায়ীরা জানান, শেষবার যখন লোহিত সাগর দিয়ে জাহাজ চলাচলে সমস্যা হচ্ছিল, তখন পথ পাল্টে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ অব গুড হোপ ঘুরে কনটেইনার ইউরোপ কিংবা আমেরিকায় পাঠাতে শিপিং খরচ প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বেড়েছিল। পাশাপাশি, সময়ও তখন দুই থেকে তিন সপ্তাহ বেশি লাগছিল। এখন যদি হরমুজ প্রণালি দীর্ঘ মেয়াদে বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে সব ধরনের খরচ বাড়বে। কমে যাবে আমদানি-রপ্তানিও।
- বিষয় :
- হুমকি