ঢাকা বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫

দেশের খনির পাথরে অনীহা

দেশের খনির পাথরে অনীহা

মধ্যপাড়া পাথর খনি

 মাহমুদুর রহমান, পার্বতীপুর (দিনাজপুর)

প্রকাশ: ১৫ জুন ২০২৫ | ০১:১৮ | আপডেট: ১৫ জুন ২০২৫ | ১২:৪০

মন্ত্রণালয়ে চিঠি, বৈঠক, এমনকি বাকি দিয়েও পাথর বেচতে পারছে না দিনাজপুরের পার্বতীপুরের মধ্যপাড়া খনি কর্তৃপক্ষ। ইয়ার্ডের ধারণক্ষমতা ১৪ লাখ টন। এরই মধ্যে সাড়ে ১১ লাখ টন মজুত হয়েছে। বিক্রি না হওয়ায় প্রতিদিন বাড়ছে মজুতের পরিমাণ। দ্রুত এসব পাথর বিক্রি করতে না পারলে বন্ধ রাখতে হবে খনি থেকে পাথর উত্তোলন কার্যক্রম। এতে বেকার হয়ে পড়বেন খনির প্রায় এক হাজার শ্রমিক।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে খনির দায়িত্বশীল দুই কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশে প্রতিবছর পাথরের চাহিদা ২ কোটি ১৬ লাখ টনেরও বেশি। এর সিংহভাগ আমদানি করা হয় ভারত, ভুটান ও দুবাই থেকে। স্থানীয়ভাবে পঞ্চগড়ের মহানন্দা নদী ও সিলেটের ভোলাগঞ্জ থেকে কিছু পাথর আহরণ করা হয়, যা নগণ্য। দেশের একমাত্র ভূগর্ভস্থ খনি মধ্যপাড়া থেকে পাথর উত্তোলন হয় ১৫ লাখ টন। এখানকার পাথর আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হওয়ার পরও নানা অজুহাতে তা প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবহারে অনীহা রয়েছে। পাথর আমদানির ওপর শুল্ক বৃদ্ধি ও মধ্যপাড়ার পাথরের ট্যারিফ ভ্যালু বাড়ানো প্রয়োজন। এ ছাড়া সড়ক ও জনপথ বিভাগ, সেতু বিভাগ, বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি), গণপূর্ত, রেলওয়ে ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নদী শাসন প্রকল্পে মধ্যপাড়ার পাথর ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে।

খনি থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, মধ্যপাড়া খনি থেকে প্রতিদিন সাড়ে ৫ হাজার টন পাথর উত্তোলন করা হয়, যা বছরে দাঁড়ায় প্রায় ১৫ লাখ টন। আর বিক্রি হয় বড় জোর ৯ লাখ টন। উত্তোলিত পাথরের মধ্যে ৫ থেকে ২০ মিলিমিটার আকারের ১৮ শতাংশ, ২০ থেকে ৪০ মিলিমিটার আকারের ৫ শতাংশ, ৪০ থেকে ৬০ মিলিমিটার (ব্লাস্ট) আকারের ৩৪ শতাংশ, ৬০ থেকে ৮০ মিলিমিটার আকারের ১১ শতাংশ, বোল্ডার আকারের ১৭ শতাংশ ও শূন্য থেকে ৫ মিলিমিটার (স্টোন ডাস্ট) আকারের ১৫ শতাংশ। তবে অধিকাংশ নির্মাণকাজে ৮ থেকে ১২ মিলিমিটার আকারের পাথর ব্যবহৃত হয়। এ আকারের পাথর মধ্যপাড়া খনিতে উৎপাদন হয় না। বাধ্য হয়ে অনেকে ৫ থেকে ২০ মিলিমিটার আকারের পাথর ব্যবহার করেন। এ আকারের পাথরের চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম। আবার মোট উৎপাদনের ৫১ শতাংশ ব্লাস্ট ও বোল্ডার পাথর তৈরি হয়। ব্লাস্ট ও বোল্ডারের ক্রেতা রেলওয়ে, পাউবো ও এলজিইডি।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশ রেলওয়ে বিগত সরকারের সময়ে কয়েকটি মেগা প্রকল্পে নতুন রেলপথ নির্মাণে ভারত থেকে আমদানি করা পাথরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ফলে গত তিন বছর ধরে রেলপথে মধ্যপাড়ার ব্লাস্ট পাথরের ব্যবহার কমেছে। এ কারণে বিপুল পরিমাণ মজুত গড়ে উঠেছে। সম্প্রতি রেলের পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সইয়ের আলোকে গত এক বছরে ৩০ হাজার টন ব্লাস্ট পাথর বাকিতে বিক্রি করা 

হয়েছে। অন্যদিকে পাউবোর নদী শাসন কাজে প্রচলিত ব্লকের (খোয়া-বালু-সিমেন্টের মিশ্রণ) তুলনায় খনির বোল্ডার অনেক বেশি টেকসই, উন্নতমানের ও সাশ্রয়ী। এর পরও তারা মধ্যপাড়ার বোল্ডার ব্যবহার করে না। এখানকার স্টোন ডাস্ট সড়ক নির্মাণে সিলকোট কাজে ব্যবহারোপযোগী। এটা এলজিইডির ল্যাবে উত্তীর্ণ। এর পরও তারা আমদানি করা স্টোন ডাস্ট দিয়ে রাস্তা সিলকোট করে।

মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী ডিএম জোবায়েদ হোসেন জানান, গত ৩১ মে পর্যন্ত খনি ইয়ার্ডে মজুত পাথরের পরিমাণ ১১ লাখ ৫২ হাজার টন। এর মধ্যে রেলপথে ব্যবহারযোগ্য ৬ লাখ ৯০ হাজার টন ব্লাস্ট পাথর এবং নদী শাসন কাজে ব্যবহারযোগ্য ৩ লাখ ৩৫ হাজার টন বোল্ডার মজুত রয়েছে। এসব পাথরের বিক্রি নেই। গত এক বছরে ৯ লাখ ২৬ হাজার ৭৭০ টন পাথর বেচা হয়েছে। এর মধ্যে রেলওয়ের সঙ্গে কথা বলে ৩০ হাজার টন পাথর বাকি দেওয়া হয়েছে। চলতি জুনে বিভিন্ন আকারের পাথর বেচা হয়েছে ১৫ হাজার টন।

তিনি আরও বলেন, খনির মোট উৎপাদনের ৫১ শতাংশ ব্লাস্ট ও বোল্ডার পাথর। ব্লাস্ট ও বোল্ডারের প্রধান ক্রেতা যথাক্রমে রেলওয়ে ও পাউবো। সরকারি এই দুটি প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদাররা পাথর না কেনায় খনিতে বিপুল পরিমাণ মজুত গড়ে উঠেছে।

তিনি আরও বলেন, গ্রাহকের চাহিদামতো পাথর উৎপাদন করতে গেলে খনির নকশা পরিবর্তন করে অতিরিক্ত ক্র্যাশিং প্লান্ট বসাতে হবে। ঠিকাদারের সঙ্গে বর্তমান চুক্তির আলোকে তা সম্ভব না। তা ছাড়া বিষয়টি সময়সাপেক্ষ।

উল্লেখ্য, ২০০৭ সালের ২৫ মে মধ্যপাড়া কঠিন শিলা খনি বাণিজ্যিক উৎপাদনে যায়। ২০১৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে খনির উৎপাদন ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করে আসছে জার্মানিয়া ট্রেস্ট কনসোর্টিয়াম (জিটিসি)। এটি বেলারুশের জেএসসি ট্রেস্ট সকটোস্ট্রয় ও দেশীয় প্রতিষ্ঠান জার্মানিয়া করপোরেশন লিমিটেড নিয়ে গঠিত। বর্তমানে খনি ভূগর্ভে বিশ্বমানের অত্যাধুনিক মাইনিং ইকুইপমেন্ট বসিয়ে ইউরোপিয়ান প্রকৌশলী ও খনি শ্রমিক দিয়ে পাথর উত্তোলন কাজ চালানো হচ্ছে। পূর্ণ মাত্রায় পাথর উৎপাদন করায় ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে মুনাফা করে আসছে খনিটি। জিটিসির প্রথম দফা চুক্তির মেয়াদ শেষ হয় ২০২১ সালের ২ সেপ্টেম্বর। দ্বিতীয় দফা চুক্তির আওতায় ২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর থেকে পাথর উৎপাদন করছে তারা। দ্বিতীয় দফা চুক্তি অনুযায়ী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ৬ বছরে ৮৮ লাখ ৬০ হাজার টন পাথর উত্তোলন করে দেবে।

আরও পড়ুন

×