জ্বালানি তেল মজুত আছে ৪৫ দিনের

কোলাজ
সারোয়ার সুমন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ২১ জুন ২০২৫ | ০১:১২ | আপডেট: ২১ জুন ২০২৫ | ১৩:০৭
পরিশোধিত ও অপরিশোধিত মিলিয়ে ১৪ লাখ টন জ্বালানি তেলের মজুত সক্ষমতা আছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি)। এই তেল দিয়ে মাত্র ৪৫ দিনের চাহিদা মেটাতে পারে বাংলাদেশ। এ জন্য আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমলেও তাৎক্ষণিক এর সুফল পায় না দেশের মানুষ। সরবরাহ প্রক্রিয়ায় কোনো কারণে বাধা এলে সৃষ্টি হয় আতঙ্ক। ইরান-ইসরায়েলের চলমান সংঘাত যুদ্ধে রূপ নিলে নতুন সংকটে পড়বে দেশ। কারণ দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ৩৪ শতাংশ ও গণপরিবহনের ৯০ শতাংশই জ্বালানি তেলের ওপর নির্ভরশীল। কৃষির সেচকাজও জ্বালানি তেলনির্ভর।
অথচ চাহিদা বিবেচনায় মজুত সক্ষমতা বাড়াতে ১৩ হাজার কোটি টাকায় নতুন আরও চারটি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছিল বিপিসি। তবে তারা নির্ধারিত সময়ে একটি প্রকল্পও শেষ করতে পারেনি। প্রকল্পগুলো শেষ হলে নতুন করে আরও ২ লাখ ৫৮ হাজার ৮০০ টনের মতো জ্বালানি তেলের মজুত সক্ষমতা অর্জন করতে পারত দেশ। তখন বিপিসির মজুত সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়াত মোট জ্বালানি চাহিদার প্রায় এক-চতুর্থাংশ। প্রসঙ্গত, মধ্যপ্রাচ্যে সংকটের পর এখনও জ্বালানি তেল নিয়ে কোনো জাহাজ বাংলাদেশে আসেনি।
বিপিসির চেয়ারম্যান মো. আমিন উল আহসান বলেন, ‘তেলের মজুত সক্ষমতা বাড়াতে বেশ কিছু প্রকল্প চলছে। নানা কারণে এগুলো সময়মতো শেষ করতে পারিনি। তবে বড় সব প্রকল্প শিগগির বাস্তবায়িত হবে। এটি করা গেলে আমদানি খরচ কমবে। কমে যাবে মজুত ঝুঁকিও।’ ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে সরবরাহ সংকট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সৌদি ও দুবাইয়ে তেল সরবরাহকারী কোম্পানিগুলো কোনো সমস্যা হবে না বলে আমাদের আশ্বস্ত করেছে। তা ছাড়া আমরা পরিশোধিত জ্বালানি তেল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে আমদানি করি। সৌদি ও দুবাই থেকে শুধু অপরিশোধিত জ্বালানি তেল (ক্রুড অয়েল) আনা হয়। তবে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে জাহাজ ভাড়া বেশ বেড়ে যাবে।’
একটি প্রকল্পও নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি
সমুদ্র থেকে পাইপলাইনে স্থলভাগে জ্বালানি তেল পরিবহনের জন্য ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপলাইন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বিপিসি। ২০১৫ সালে এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু হয়, যা গত ডিসেম্বরে শেষ হয়েছে। এ প্রকল্পে বিপিসির মোট জ্বালানি তেলের মজুত সক্ষমতা বাড়ত দুই লাখ টন। এর মধ্যে ক্রুড অয়েল মজুত সক্ষমতা বাড়ত ১ লাখ ২৫ হাজার টন। আর ডিজেলের বাড়ত ৭৫ লাখ টন। তবে কমিশনিং শেষ হলেও প্রকল্পটি চালু করতে আরও কিছু সময় প্রয়োজন। কারণ অপারেশন কার্যক্রম পরিচালনা করতে বিদেশি কোম্পানি নিয়োগ প্রক্রিয়া এখনও শেষ করতে পারেনি বিপিসি।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উড়োজাহাজের জ্বালানি তেল সরবরাহের জন্য ৩৪০ কোটি টাকায় নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর কাঞ্চন ব্রিজ থেকে ঢাকার কুর্মিটোলা পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার পাইপলাইন প্রকল্পের মেয়াদ দুই দফায় বাড়িয়েও শেষ করা যায়নি।
চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত জ্বালানি তেল পরিবহনে ৩ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৫০ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণ করছে বিপিসি। ২৫ বছর মেয়াদি এ প্রকল্প শেষ হলে বছরে বাড়ত ৫৪ লাখ টন ডিজেল পরিবহনের সক্ষমতা। ভারত থেকে পাইপলাইনে জ্বালানি তেল আমদানির জন্য ৩১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এই প্রকল্পও শেষ হয়নি নির্ধারিত সময়ে।
আমদানি করতে হয় চাহিদার ৯২ শতাংশ
দেশে ডিজেল, পেট্রোল, অকটেন, ফার্নেস অয়েল, মেরিন ফুয়েল, বিমানের জ্বালানিসহ মোট তেলের চাহিদা রয়েছে গড়ে ৭২ লাখ টনের মতো। এ চাহিদার মাত্র ৮ শতাংশ পূরণ হয় স্থানীয় উৎস থেকে। বাকি চাহিদা পূরণ হয় আমদানির মাধ্যমে। বিপিসি অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে সৌদি আরবভিত্তিক সৌরি অ্যারাবিয়ান অয়েল কোম্পানি (সৌদি আরামকো) এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) আবুধাবি ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের (অ্যাডনক) কাছ থেকে। এর বাইরে আটটি দেশ থেকে জিটুজি চুক্তি ও আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে বিপিসি পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে। ইরান-ইসরায়েল সংঘাত তীব্র হতে থাকায় দেশের জ্বালানি সরবরাহ স্বাভাবিক থাকবে কিনা, তা নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।
আমদানিতে খরচ ৭৬ হাজার কোটি টাকা
বিপিসির তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের জন্য ৫৯ লাখ ১০ হাজার টন পরিশোধিত এবং ১৪ লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির পরিকল্পনা করে বিপিসি। এ জন্য বরাদ্দ রয়েছে ৭৬ হাজার কোটি টাকা। বিপিসির আমদানি করা জ্বালানির মধ্যে বেশির ভাগই ডিজেল। সংস্থাটি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জ্বালানি তেল আমদানি করে ৬৩ লাখ ৭১ হাজার ৫৭৩ টন। এতে বিপিসির খরচ হয় ৫৫ হাজার ৬৬৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে পরিশোধিত তেল ডিজেল, পেট্রোল, অকটেন, জেট ফুয়েল আমদানিতে ব্যয় করা হয় ৪২ হাজার ৬৭ কোটি টাকা। ফার্নেস অয়েল আমদানিতে ৪ হাজার ১০৩ কোটি ও মেরিন ফুয়েল আমদানিতে ১০৭ কোটি টাকা খরচ হয়। আর অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিতে ব্যয় হয় মোট ৯ হাজার ৩৮৬ কোটি টাকা।
সংঘাত শুরুর পর আসেনি কোনো জাহাজ
ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের পর এখনও জ্বালানি তেলের কোনো জাহাজ বাংলাদেশে আসেনি বলে জানিয়েছেন বিপিসির মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্য ও অপারেশন) মনিলাল দাশ। তিনি বলেন, এক লাখ ক্রুড অয়েল বোঝাই আমাদের একটি জাহাজ ২৮ জুন বাংলাদেশে আসার কথা রয়েছে। হরমুজ প্রণালি অতিক্রম করে জাহাজটির দেশে আসা নিয়ে আমরা দুশ্চিন্তায় ছিলাম। তবে সেই বাধা অতিক্রম করেছে জাহাজটি। এক লাখ টন ক্রুড নিয়ে আরেকটি জাহাজ আসার কথা রয়েছে ২২ জুলাই।
মজুত আছে কত দিনের তেল
বিপিসি জানায়, দেশে বিভিন্ন ধরনের তেল গড়ে ৪৫ দিনের মজুত থাকে, যার গড় পরিমাণ প্রায় ১৪ লাখ টন। ইস্টার্ন রিফাইনারিতে ক্রুড অয়েল পরিশোধন করার সক্ষমতা বছরে প্রায় ১৫ লাখ টন। সে হিসাবে সৌদি আরব থেকে বছরে ৬-৭ লাখ টন আনা হয়। আবুধাবি থেকেও একই পরিমাণ ক্রুড অয়েল আমদানি করা হয়। ১৪ জাহাজে করে বছরে প্রায় ১৪ লাখ টন ক্রুড অয়েল আমদানি করা হয় বাংলাদেশে। এ ছাড়া পরিশোধিত তেল আমদানি করতে আটটি দেশের সঙ্গে সরকারি পর্যায়ে চুক্তি আছে বিপিসির।
- বিষয় :
- জ্বালানি
- জ্বালানি তেল